নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভলগেটে পণ্য পরিবহন থেমে নেই

জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের ভিডিও ফাঁস

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

দুবাই থেকে আটাশ হাজার দুইশ’ টন পাথর নিয়ে এমভি ওসপ্রে নামের একটি মাদার ভ্যাসেল চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। জাহাজটি থেকে পাথর খালাসে একটি লাইটারেজ জাহাজও নেয়া হয়নি। পুরো পণ্যই খালাস করা হয় অবৈধ ভলগেটের মাধ্যমে। বন্দরের বহির্নোঙরে নোঙর করা উক্ত মাদার ভ্যাসেলে এক সাথে চারটি ভলগেট লাগিয়ে পণ্য খালাসের একটি ভিডিও প্রকাশ হওয়ায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। বহির্নোঙর ও বন্দর চ্যানেলে ভলগেট চলাচল পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে নানা ধরনের সার্কুলার জারির মাত্র দিন কয়েকের মাথায় এই ধরনের একটি ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দুই শতাধিক অবৈধ ভলগেট চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম কাস্টমস, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর, ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলসহ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টরের সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে। এসব ভলগেট চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে শুধু লাখ লাখ টন পণ্যই পরিবহন করছে না বরং বড় ধরনের ঝুঁকিও সৃষ্টি করছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের একাধিক কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ভলগেট পুরোপুরি নিষিদ্ধ। বালি পরিবহনের জন্য বিশেষভাবে তৈরি এসব নৌযান কোনো ভাবেই বহির্নোঙর থেকে পণ্য পরিবহন করতে পারে না। নেভাল আর্কিটেক্টচারাল ডিজাইন ছাড়া নির্মিত নৌযানগুলো বিভিন্ন ডক ইয়ার্ডে মিস্ত্রি ও ওয়েল্ডার মিলে তৈরি করেন। কোনো রকমে নদী ও খালে ভাসিয়ে রাখার উপযোগী করে তৈরি করা এসব ভলগেট দেশের বিভিন্ন স্থানে বালি পরিবহন করে। লাইটারেজ জাহাজ বা যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করে এমন রুটে ভলগেট বা বাল্কহেড চলাচল পুরোপুরি নিষিদ্ধ। দেশের কোথাও ভলগেটের বে ক্রসিংয়ের অনুমোদন নেই। কিন্তু গত বেশ কিছুদিন ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ও বন্দর চ্যানেলে শত শত ভলগেট চলাচল করছে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে পণ্য নিয়ে আসা বড় বড় মাদার ভ্যাসেল থেকে এসব ভলগেটে পণ্য খালাস করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ওভার সাইডেও ভলগেট দিয়ে পণ্য খালাসের ঘটনা নতুন কিছু নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, একশ্রেণির আমদানিকারকের পক্ষে এজেন্ট কিংবা পণ্য খালাসের দায়িত্বে থাকা প্রতিনিধিরা গোপনে লাইটার জাহাজের বিকল্প হিসেবে ভলগেট ব্যবহার করছে। টন প্রতি একশ’ টাকা ভাড়া বাঁচানোর জন্যই ভলগেটের ব্যবহার দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে প্রতিটন পণ্য লাইটারেজ জাহাজে পরিবহন করতে ভাড়া আদায় করা হয় ৫৪৮ টাকা। ভলগেটে প্রতি টন পণ্য ৪৫০ টাকায় পরিবহন করা যায়। টন প্রতি একশ’ টাকা বাঁচানোর জন্য কোটি কোটি টাকার পণ্যের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবহন পুরো সেক্টরেই বিশৃংখল পরিস্থিতি তৈরি করছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। ভলগেটের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে পাথর ও কয়লা পরিবহন করা হয়। অনেক সময় পণ্যের আমদানিকারক জানেনই না যে, তাদের কোটি কোটি টাকার পণ্য অননুমোদিত ভলগেটে বোঝাই করে পার করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বহির্নোঙর থেকে পাথর কয়লাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে চলাচলের সময় বেশ কয়েকটি ভলগেট ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন রুটে ভলগেট ডুবির ঘটনা পুরো সেক্টরকে হুমকির মুখে ফেলছিল। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থা থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এই সময় পনৗবাণিজ্য অধিদপ্তর, ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল এবং চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বিষয়টি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর ভলগেট যে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরসহ বন্দর চ্যানেলের জন্য বড় ধরনের হুমকি সেই সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত হন। বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে ভলগেট চলাচল নিষিদ্ধ করে সার্কুলার জারি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে শিপিং এজেন্ট এবং স্টিভিডোরিং এজেন্সিগুলোকেও সতর্ক করা হয়। কোনো মাদার ভ্যাসেল থেকে অননুমোদিত ভলগেটে পণ্য খালাস না করার নির্দেশনাও দেয়া হয় মাত্র দিন কয়েক আগে।
কিন্তু এই নির্দেশনা দেয়ার কয়েকদিনের মাথায় বহির্নোঙরে অসংখ্য ভলগেট পণ্য খালাস করতে পুনরায় যোগ দিতে শুরু করেছে। চট্টগ্রামের একটি শীর্ষ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ২৮ হাজার ২শ’ টন পাথর নিয়ে আসা একটি মাদার ভ্যাসেলে একই সাথে চারটি ভলগেট লাগিয়ে পণ্য খালাস করা হচ্ছিল। মাদার ভ্যাসেলটি থেকে পণ্য খালাসের জন্য একটি লাইটারেজ জাহাজও নেয়া হয়নি। বন্দর কর্তৃপক্ষের সার্কুলার কিংবা প্রয়োজনীয় অনুমোদনের কোন তোয়াক্কা না করেই অবৈধ ভলগেট দিয়ে পুরো জাহাজের সব পণ্যই খালাস করা হয়েছে। জাহাজ থেকে ভলগেটে পণ্য বোঝাই করার দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সেক্টরের বিভিন্ন গ্রুপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়। আর এই ভিডিওটি প্রচার হওয়ার সাথে সাথে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অভ্যন্তরীন নৌ পরিবহন সেক্টরের একাধিক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, অননুমোদিত এবং অবৈধ ভলগেটগুলোর খুঁটির জোর এত শক্ত যে তারা বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাকেও পাত্তা দিচ্ছে না। এদের অবৈধ তৎপরতার খুঁটির জোর কোথায় তা খতিয়ে দেখার জন্যও বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এই জাহাজ থেকে পণ্য কিভাবে কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়া খালাস করা হলো তা খতিয়ে দেখলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ মন্তব্য করেছেন।
এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভলগেটে পণ্য পরিবহন অবৈধ বলে উল্লেখ করে বলেন, পণ্য পরিবহন তো দূরের কথা, এগুলোর এখানে খালিও চলাচল করার কোনো সুযোগ নেই। গতকাল ভিডিও কিংবা একটি মাদার ভ্যাসেলে একই সাথে চারটি ভলগেটের পণ্য খালাসের বিষয়টি জানা নেই বলে জানান তিনি। তবে এই ধরনের অপতৎপরতা চললে তা বন্ধ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বালির জাহাজে পণ্য পরিবহন সম্পূর্ণ অবৈধ উল্লেখ করে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশীদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, বন্দরসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিল। দেয়া হয়েছিল কিছু নির্দেশনা। অথচ এসব নির্দেশনাকে কেউ পাত্তা দেয়নি। ২৮ হাজার টনেরও বেশি পণ্য নিয়ে আসা একটি জাহাজের সব পণ্যই খালাস করা হয়েছে। অথচ একটি লাইটারেজ জাহাজও নেয়া হয়নি। অবৈধ ভলগেটগুলোর এমন দাপটে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সেক্টরই দিনে দিনে অসহায় হয়ে উঠছে বলেও মন্তব্য করেন মাহবুব রশিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবন্ধ হলো সেই দোকানের নির্মাণ কাজ
পরবর্তী নিবন্ধপিলখানা ট্রাজেডির একযুগ আজ