বাজেটের মঞ্জুরি দাবির উপর আলোচনার সময় নির্বাচন ব্যবস্থা বিতর্ক হয়ে গেল সংসদে। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। বিএনপির সদস্যরা তুলেছেন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি। তার জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আদালতের রায়ের বাইরে গিয়ে নির্দলীয় সরকার আনার কোনো সুযোগ নেই। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের এখনও দেড় বছর বাকি থাকলেও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর সেই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আলোচনা চলছে। বৃহস্পতিবার সংসদে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেটে প্রস্তাবিত দায়যুক্ত ব্যয় ব্যতীত অন্যান্য ব্যয় সম্পর্কিত মঞ্জুরি দাবির উপর আলোচনায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের বরাদ্দের দাবি নিষ্পত্তির সময় নির্বাচন কমিশনের প্রসঙ্গ আসে। খবর বিডিনিউজের।
জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, ‘সুষ্ঠু ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা (ইসি) এখন দন্তহীন বাঘ। নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালী হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তত যৌক্তিকতা হারাবে, মন্তব্য করে ইসির অধীনে ‘নির্বাচনী পুলিশ’ গঠনের প্রস্তাব করেন এই আইনপ্রণেতা।
জাতীয় পার্টির সদস্য রওশন আরা মান্নান বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে কাজ করলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। গত ১০ বছরে নির্বাচন কমিশনের উপর মানুষের ‘অনাস্থা তৈরি হয়েছে’ দাবি করে বিএনপির হারুনুর রশীদ কটাক্ষ করে নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ অর্থ প্রশাসন ও পুলিশকে দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘এখন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করে না। নির্বাচন করে প্রশাসন।’
বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, ‘যখন দেশে নির্বাচন থাকে তখন নির্বাচন কমিশনের প্রশ্ন আসে। যদি নির্বাচন না থাকে, দিনের ভোট রাতে হয়, তখন নির্বাচন কমিশন দিয়ে কী হবে? এখন নির্বাচন মল্লযুদ্ধ। সিইসি বলেছেন, ভোটের মাঠে বিএনপিকে জেলেনস্কির মতো মাঠে থাকতে হবে। ভোট কি যুদ্ধ? একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, গোপন বুথে ডাকাত বড় চ্যালেঞ্জ। এই ডাকাত শুধু দলীয় ডাকাত নয়। পুলিশ প্রশাসনও এই ডাকাতি করে। এই ডাকাতির পর যেভাবে পুরস্কৃত করা হয় ভবিষ্যতে ডাকাত আরও বাড়বে।’ সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে কোনভাবেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে মন্তব্য করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুন।
রুমিন বলেন, সাবেক নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীনকে পুরস্কার হিসেবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়। অবসরে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগে তিনি ইউরোপ সফরে যান। সে সফরের অভিজ্ঞতা তিনি অবসর জীবনে কাজে লাগাবেন। এ ভাবে পুরস্কৃত করতে থাকলে বিনা ভোটে সংসদ গঠন চলতেই থাকবে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘সেখানে একজন সংসদ সদস্যকে নির্বাচন কমিশন সামাল দিতে পারেনি। তার হুমকি-ধমকি সহ্য করতে পারেনি। বারবার অনুরোধ করে তাকে এলাকা থেকে সরাতে পারেনি। যে কমিশন একজন সংসদ সদস্যকে সামলাতে পারে না তারা জাতীয় নির্বাচনে তিনশ সংসদ সদস্যকে কীভাবে সামলাবেন?’ একই দলের জ্যেষ্ঠ নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেন। বিরোধী সদস্যদের আলোচনার জবাব দিতে গিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এখানকার আসনে বসে বলছেন নির্বাচন হয় না। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, উনি সংসদে গেলেন কীভাবে? এর জবাব উনি দেবেন।’
বিএনপি আমলে ভোটের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভোট কীভাবে হয়েছে, তা আমরা দেখেছি। ওই সময় কারও ভোট কেন্দ্রে যাওয়া লাগত না, ভোট হয়ে যেত। আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন তাদের (বিএনপি) ছিল। মাগুরার ভোটের কথাও সবাই জানে। ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি কী করেছে, এগুলো কি উনারা ভুল গেছেন?’
বিএনপির সদস্যদের নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ ছাঁটাই করে এক টাকা দেওয়ার প্রস্তাবের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘উনারা বলেছেন এক টাকা দিতে। উনারা পারবেন এক টাকা দিয়ে কোনো নির্বাচন করে দিতে? পারবেন না। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনের টাকা লাগবে। নির্বাচন কমিশন তার অর্থ ব্যয়ে পুরোপুরি স্বাধীন।’
অবসরের দুই দিন আগে স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীনের বিদেশ সফর বিষয়ে রুমিনের অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিদেশের আমন্ত্রণে মন্ত্রী মহোদয় এবং সচিব টিম নিয়ে ডেল্টা প্লান বিষয়ে গিয়েছিলেন। তারা সেখান থেকে শিখে এসেছেন। এটা হয়েছে বিদেশি সরকারের ব্যবস্থাপনায়। তখন তিনি সচিব ছিলেন। এখানে কি কোনো অন্যায় আছে? জানি না, উনি কোথা থেকে অন্যায় দেখলেন।’
নির্বাচন কমিশন আইন তৈরির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আনিসুল হক বলেন, এখন বিএনপির দাবি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতে হবে, তাহলে উনারা ভোটে আসবেন। এই সংসদে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা দিয়েছে। উচ্চ আদালতের এই রায়ের এক সুতাও বাইরে সরকার যাবে না। বিএনপি বার বার বলছেন, তাদেরকে নির্বাচনে আনতে হবে। তারা কি পাকিস্তানে থাকে যে সেখান থেকে ডেকে আনতে হবে? তারা তো বাংলাদেশে থাকে। উনারা নির্বাচন করতে চাইলেই নির্বাচন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের যে জন্য প্লেইং ফিল্ড দরকার সেটা করা হবে। তার এ পদক্ষেপ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন। সেটা করা হয়েছে। পরে আরেকটি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ছাঁটাই প্রস্তাব তুলতে গিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে বিএনপির হারুন বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে বলিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছেন। ‘বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়াতে কোনো কৃতিত্ব নেই। মাঠে মূল প্লেয়ার দুটা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই দলকেই মাঠে রাখতে হবে।’