আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজাল এখন একটি জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। অত্যধিক লোভের বশবর্তী হয়ে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যে ভেজাল দিয়ে মানুষের জীবনকে সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বলা যায়, খাদ্যে ভেজাল বর্তমানে এমন এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে, যা মানুষের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন আমরা যা খাচ্ছি, তা আদৌ নিরাপদ কিনা–প্রশ্নটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, দুই লাখ মানুষ কিডনি রোগে, দেড় লাখ ডায়াবেটিসে ভোগেন এবং প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ প্রতিবন্ধী শিশু জন্মগ্রহণ করে, যার অনেকাংশই গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতা থেকে উদ্ভূত। এ ভয়াবহ প্রবণতার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে খাদ্যে ভেজাল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিদিন আমাদের প্রয়োজন বিশুদ্ধ, টাটকা, সংরক্ষকবিহীন, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকমুক্ত, পুষ্টিকর খাবার। অথচ মুনাফার লোভে দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে খাদ্যে শিল্পজাত রাসায়নিক, রঙ এবং কৃত্রিম উপাদান মেশাচ্ছেন। যদিও আইন–শৃঙ্খলা বাহিনী এ সমস্যা সমাধানে কাজ করছে, অনেক ক্ষেত্রেই তারা ভেজালকারীদের শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। শক্তিশালী চক্র আইনকে পাশ কাটিয়ে এমনভাবে নকল খাদ্য উৎপাদন করছে, যেখানে মূল উপাদানের বদলে কম খরচের, ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে দুগ্ধজাত পণ্য, তেল–চর্বি, ফলমূল, ঘি, শাকসবজি, দানাজাতীয় খাদ্য, মধু, চা–কফি ইত্যাদি খাদ্যে ভেজালের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি এবং এটি অনেক সময় জীবনঘাতী হয়ে উঠছে। খাদ্যে ভেজালের কারণে অ্যালার্জি, পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, অঙ্গ–প্রত্যঙ্গের ক্ষতি, হরমোন ভারসাম্যহীনতা, দীর্ঘস্থায়ী রোগসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খাদ্যের পুষ্টিগুণ ধ্বংস হয়।
কিছু কোম্পানির অনৈতিক আচরণ সৎ ও নীতিনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলোর সুনামকেও কলঙ্কিত করছে। আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন মিডিয়ায় ‘অর্গানিক’, ‘নিরাপদ’, ‘সরকারি অনুমোদিত’ ইত্যাদি নানা স্লোগান দেখি; কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই খাদ্যে ভেজাল রয়েছে। সরকার এ সমস্যা মোকাবেলায় বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন খাদ্যনিরাপত্তা আইন প্রয়োগ, অপরাধীদের জন্য কঠোর শাস্তি, ভ্রাম্যমাণ আদালত, জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক ক্যাম্পেইন এবং পরীক্ষাগার স্থাপন। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি বিএসটিআই সিলযুক্ত পণ্যের মধ্যেও অনেক সমস্যা থেকে যায়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে প্রায়ই এমন ভেজাল পণ্যের সন্ধান মেলে।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ বিষয়ে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। খাদ্যনিরাপত্তা ও গুণগত মান নিশ্চিতে লেবেলিং, অনুমোদিত উপাদান, কীটনাশকের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণে বিএসটিআইয়ের নীতিমালা অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। পাশাপাশি বিএসটিআইয়ের পরিদর্শন ও অডিট বিভাগ বিভিন্ন কৃষিখামার, প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র, বাজার ইত্যাদিতে নিয়মিত পরিদর্শন চালিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ২৫ লাখ ক্ষুদ্র বা অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসায়ী ও ১৮টি মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া দেশে প্রায় ৪৮৬টি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব প্রতিষ্ঠানের অধীন প্রায় ১২০টি আইন ও নীতিমালা রয়েছে। দেশে ক্ষুদ্র বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাদ্য ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগের পেশাগত জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ নেই। সব মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য একটি জাতীয় প্রত্যাশা। দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে যেন সবাই সহজে ও সুলভ মূল্যে খাদ্য পেতে পারে, সে জন্য সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
মোট কথা, খাদ্যে ভেজাল রোধ করতে দেশের প্রধান খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটকে (বিএসটিআই) আরো সতর্ক ও সক্রিয় হতে হবে। ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে দরকার কার্যকর ভূমিকা। ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হলে কিছুদিন ভেজালমুক্ত খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায়, কিন্তু পরে যেই–সেই হয়ে যায়। এর থেকে পরিত্রাণে আমাদের সমাজিকভাবেও নীতি–নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ব্যবসায়ীদের সৎ পন্থা অবলম্বন করতে হবে। নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে সততা, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার আলোকে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। ভেজাল প্রতিরোধে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নৈতিকতাবোধ, উৎপাদক, বিপণনকারী, ভোক্তা সবাইকেই সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকেও স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা প্রদান ও দক্ষ জনবল নিয়োগের মাধ্যমে আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে।