একটি দেশে নানা জাতের নানা ধর্মের লোক বসবাস করে। ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সবাই সে দেশের নাগরিক। তাদের বিভিন্ন ধরনের পরিচয় থাকতে পারে। তবে যারা বংশ পরম্পরায় যে দেশে বসবাস করে তারা সে দেশের নাগরিক হয়ে যায়। সে দেশের পরিচয়ই তাদের আসল পরিচয়। জাতীয়তাবাদের পরিচয় সব দেশে থাকে। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশী, যেটা তার নাগরিক পরিচয়। আবার এদেশের মানুষ বাঙািল, এটা তার জাতীয় পরিচয়। এ পরিচয়ের সাথে দীর্ঘ ইতিহাস জড়িত। একইসাথে আবেগ ও ত্যাগের দৃষ্টান্ত। যে ত্যাগের মধ্য দিয়ে বাঙালি শুধু মাতৃভাষাকে রক্ষা করেনি জাতি হিসেবেও নিজেরে অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে। স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়েছে। পূর্ব বাংলার বাঙালিরা নিজস্ব একটি ভূখণ্ড স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশটি অর্জিত হয়েছে। এ যুদ্ধে বাঙালির সাথে এদেশের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর মানুষেরাও অংশগ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে চাকমা মারমা ত্রিপুরা ছাড়াও আরো নৃগোষ্ঠী রয়েছে। বহুকাল থেকে এরা আদিবাসী হিসেবে পরিচিত। এদেরও আলাদা আলাদা জাতিসত্তা রয়েছে। বাঙালি যেমন একটি জাতি তারাও একেকটি জাতি। তাদের ভাষা কৃষ্টি আলাদা। তাদেরও রয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তা। তারাও বাংলাদেশের নাগরিক। এদেশে বাঙালির যে অধিকার তাদেরও একই অধিকার। তারা চাকমা মারমা ত্রিপুরা এসব পরিচয়ে পরিচিত।
পাকিস্তানের মানুষদের পাকিস্তানী বলা হয়। পাকিস্তানে পাঞ্জাবী, পাঠান, বেলুচি, সিন্ধী নানা জাতের মানুষ আছে। তারা আলাদা প্রদেশে বসবাস করে, তাদের ভাষাও আলাদা। তাদের আচার অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতি একই রকম নয়। অনেক কিছুতে তাদের মাঝে ভিন্নতা রয়েছে। একই প্রদেশে আবার নানা গোত্রের বা সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। এক গোত্রের সাথে আরেক গোত্রের বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তারে অনেক সময় হিংসাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এমনকি রক্তপাতের ঘটনাও ঘটে যায়। সর্দার নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে এসব ঘটনা বেশি সংঘটিত হয়। এক প্রদেশের মানুষ আরেক প্রদেশে অবাধে যাতায়াত ও বসবাস করতে পারে। করাচী, লহোর, ইসলামাবাদের মতো বড় বড় শহরে যে কোন প্রদেশের মানুষেরা ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারে এবং এসব শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে। এক অঞ্চলের মানুষের সাথে আরেক অঞ্চলের মানুষের আচার আচরণে ভিন্নতা থাকলেও ইচ্ছা ও সামর্থ্য অনুযায়ী যে কোনো শহরে বা প্রদেশে জীবন যাপন করতে পারে। যে যেখানে থাকুক না কেন পরিচয় হয় পাকিস্তানী।
পার্শ্ববর্তী ভারত একটি বৃহৎ দেশ। আশে পাশের দেশের তুলনায় অনেক বড় দেশ। অনেক রাজ্য নিয়ে এ ভারত। এদেশে বহু জাতের মানুষের বসবাস। এক অঞ্চলের মানুষের সাথে পূরবর্তী অঞ্চলের মানুষের তেমন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ধর্মীয় দিক থেকে একইসাথে সাংস্কৃতিক দিক থেকেও অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ভাষাও সম্পূর্ণরূপে আলাদা। এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যের মানুষেরা মন মানসিকতার দিক থেকে কিছুটা আলাদা। কোনো কোনো রাজ্য আশে পাশের দেশের চেয়েও বড়। কোনো রাজ্য অনেক সমৃদ্ধশালী আবার কোনটা পেছনে পড়ে আছে। মানুষের জীবন যাত্রার মানেও অনেক ফারাক। তা আবার একই রাজ্যের মধ্যেও রয়েছে। দাঙ্গা হাঙ্গামা ধর্মীয় হানাহানি জাতিগত বিদ্বেষ ভারত বর্ষে ঐতিহাসিকভাবে বিরাজ করে। এদেশে আবার ধনী দরিদ্রের ব্যবধান অনেক বেশি। অঙ্গরাজ্যগুলো অভ্যন্তরীণ প্রায় সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পাবে। ফলে কোনো সমস্যার তীব্র আকার ধারণ করলেও তা সহজে অন্যান্য রাজ্য ছড়িয়ে পড়তে পারে না। নানাবিধ সমস্যার বহুজাতিক একটি দেশে জাতীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকে। এ ভূখণ্ডের মানুষেরা নিজেদের ভারতীয় বা ইন্ডিয়ান হিসেবে পরিচয় দেয়। ভারতের আরেক নাম ইন্ডিয়া।
নেপাল ভুটান শ্রীলংকা কিংবা মিয়ানমারের কথা বলি না কেন এসব দেশেও জাতিগত সমস্যা রয়েছে। বিভিন্ন জাতের বা ধর্মের মানুষ এসব দেশে বসবাস করে। শ্রীলংকার জাতিগত সংঘাত একসময়ে দেশটিকে বিভক্ত করে দিয়েছিল। মিয়ামনারের যে সমস্যা তা যেন কোনো কালে নিরসন হবে না। দুর্বলের ওপর সবলের নিপীড়ন কখনো বন্ধ হবে না। এমনকি দেশ থেকে বিতাড়িত করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তারপরও এসব দেশের মানুষেরা নিজ দেশে থাকতে চায়। মিলেমিশে নিজের দেশটাকে গড়ে তুলতে চায়। নেপালের মানুষেরা নিজেদের নেপালী পরিচয় দিতে ভালোবাসে। ভুটানের মানুষেরা ভূটানী এবং শ্রীলংকার মানুষেরা লংকান পরিচয়ে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত। মিয়ামনারের আগের নাম ছিল বার্মা। তাই এখানকার মানুষদের বর্মি বা বার্মিজও বলা হয়ে থাকে। তবে এদেশটির সাথে অন্যদেশগুলোর পার্থক্য অনেক বেশি। মিয়ানমার ছাড়া অন্য দেশগুলোতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও মুসলিম খৃষ্ঠান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা বসবাস করে। ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে এসব দেশে জাতিগত সমস্যাগুলো নিরসন করা হয়। নিজ নিজ দেশের পরিচয়ে পরিচিত হতে কোনো সমস্যা হয় না। নাগরিক হিসেবে ধর্ম গোত্র বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সমান সুবিধা ভোগ করে থাকে।
আমাদের দেশে কেউ নিজেকে বাঙালি বলতে কিছুটা গর্ব বোধ করে। আবার অনেক বাংলাদেশী বলে পরিচয় দিতে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আসলে সব বাংলাদেশীরা বাঙালি নয়। তার অন্যতম কারণ ভারতের পশ্চিম বাংলার লোকেরা বাঙালি। আবার এদেশেও চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ অনেক ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর বসবাস। তারা কখনো বাঙালি হতে পারে না। তারা নিজস্ব পরিচয়ে পরিচিত। তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। তবে তারা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক অর্থাৎ বাংলাদেশী। অনেকে বিষয়টিকে সহজ করে ভাবতে পারে না বলে এটা নিয়ে এতো জটিলতা। জুলাই আগস্টের দেয়ালের গ্রাফিতিতে কোথাও লেখা আছে ‘আমরা সবাই বাঙালি’ আবার কোথাও ‘আমরা সবাই বাংলাদেশী’। আমরা যেভাবে বাঙালি সত্য ঠিক সেভাবে বাংলাদেশী। আবার বাংলাদেশের বাঙালি ছাড়াও ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর মানুষেরাও সত্য। তারা এদেশের অধিবাসী, তারাও বাংলাদেশী। অর্থাৎ আমরা সবাই বাংলাদেশী।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।