আজন্ম নিঃসঙ্গতাকে ভালোবেসে যাওয়া কবি হেলাল হাফিজের বিদায় মুহূর্তটা আর জনহীন থাকল না। ফুলে ফুলে ঢেকে গেল কফিন, চোখের পানি ফেললেন কেউ কেউ। ফুলেল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় বিদায় জানানো হলো প্রিয় কবিকে। রাষ্ট্রের উপদেষ্টা, সচিব, বিভিন্ন দপ্তর–সংস্থার কর্মকর্তারাও এসেছিলেন কবিকে বিদায় জানাতে। ছিলেন সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিকসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষও। গতকাল শনিবার সকাল ১১টায় কবির মৃতদেহ নিয়ে আসা হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়; তার প্রথম জানাজাও হয় সেখানে। জানাজা পড়ান কবির বড় ভাই দুলাল আবদুল হাফিজ। পরে বাদ জোহর জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে দ্বিতীয় দফা জানাজার পর তার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। সেখানে বিকাল ৪টায় তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
হেলাল হাফিজের বড় ভাই দুলাল আবদুল হাফিজ বলেন, ও তো নিঃসঙ্গ জীবনটা খুব পছন্দ করতো। আমি এবং আমার স্ত্রী তাকে বিয়ের ব্যাপারেও অনেক চেষ্টা করেছি। দেখলাম, সে কোনোভাবেই রাজি হচ্ছে না। পরে অভিমান করে বলল, বাসায় আর থাকবে না। সে নিজেই এই একাকিত্বের জীবন বেছে নিয়েছিল। আমরা চেষ্টা করেছিলাম– তাকে সংসারী করতে। সে আগ্রহী হয়নি। অবশেষে ওর বিদায়টাও হলো একাকী। আমরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেছি। সে চায়নি। বলা যায়, সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েই ছিল।
অকৃতদার হেলাল হাফিজের জীবনের শেষ দিনগুলো কাটছিল ঢাকার শাহবাগের সুপার হোম নামের এক হোস্টেলে। শুক্রবার দুপুরে বাথরুমে পড়ে গেলে তার মাথায় রক্তক্ষরণ হয়। পাশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হেলাল হাফিজের একাকী জীবনের কথা উঠে এল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজের কথাতেও। তিনি দীর্ঘদিন হেলাল হাফিজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। হাসান হাফিজ বলেন, আমার পিতৃপ্রদত্ত নাম কিন্তু হাফিজ না। আমার এই নামটি হেলাল হাফিজের দেওয়া। প্রেস ক্লাব ও হেলাল হাফিজ এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমরা সবাই চেষ্টা করেছি তাকে সংসারী করতে। কিন্তু সেটি হয়নি। আমরা প্রেস ক্লাব থেকে হাসপাতালে কথা বলে তাকে ভর্তির ব্যবস্থাও করেছিলাম। পরে ডাক্তার এসে দেখেন, রোগী হাসপাতাল থেকে চলে গেছেন। তিনি এমনই ছিলেন।
হাসান হাফিজ বলেন, আমার কবি হিসেবে যতটুকু অর্জন, তার পেছনে উনার বড় অবদান আছে। আমি ভারাক্রান্ত… আসলে আমি আহত হয়েছি। অসাধারণ একটা মানুষ ছিলেন তিনি। কোমল হৃদয়ের মানুষ এই কবি। উনি বেঁচে থাকবেন উনার লেখার মধ্য দিয়ে। প্রেম ও দ্রোহের এবং বাংলাদেশে যে একটা নতুন বিনির্মাণের স্বপ্ন আমরা দেখছি, সেই প্রত্যয়ের অঙ্গীকারে হেলাল হাফিজের কবিতা আমাদের উজ্জীবিত করেছে স্বাধীনতার মন্ত্রে, উজ্জীবিত করেছে প্রগতির আন্দোলনে, সহায়তা করেছে। প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে হেলাল হাফিজকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমসহ অনেকে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে হেলাল হাফিজকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক–ই–আজম (বীরপ্রতীক)। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম, পরিচালক সরকার আমিনসহ অনেকেই ছিলেন সেখানে। এছাড়া জাতীয় প্রেস ক্লাব, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন বলেন, হেলাল হাফিজ একাকী জীবন বেছে নিয়েছিলেন। এ জীবন একান্তই তার। এমন জীবন নিয়ে আমরা আক্ষেপ করলেও তিনি খুব একটা আক্ষেপ করতেন বলে আমি মনে করি না। কবিকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর এক প্রশ্নে ফারুকী বলেন, তিনি অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন।
একটা কবিতার বই লিখেই এমন বিপুল পাঠকের ভালোবাসা পাওয়া অনেক বড় ব্যাপার। আমি যতটুকু জানি, উনি স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক পাননি। তার অনেক লেখা অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। সেখানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কিছু করার থাকলে আমরা করব।
নেত্রকোণায় বাড়ি হওয়ার সুবাদে কবিতা চেনার আগেই হেলাল হাফিজকে চিনেছেন তরুণ রাসেল হাসান। এবার এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রাসেল হাসান বলেন, উনি এলাকায় যেতেন না। কিন্তু উনাকে তো সারা দেশের মানুষ চিনতেন। ছোটবেলা থেকেই কবি হিসেবে উনার নাম শুনেছি। স্কুলে পড়ার সময় উনার কবিতা পড়েছি। আর নাইনে পড়ার সময় থেকে হেলাল চাচার সঙ্গে দেখা হয়েছে। উনি আমাকে স্নেহ করতেন, দেখা করতে বলতেন।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে হেলাল হাফিজের ছোট ভাই নেহাল হাফিজ জানালেন, হেলাল হাফিজের কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেও কবিতা লেখা শুরু করেন। তিনি বলেন, পারিবারিকভাবে বড় ভাইকে আমি বলতাম রাঙা দা। আর হেলাল ভাইকে বলতাম সোনা দা। আমার লেখা কিছু কবিতা হেলাল ভাইকে দেখাতে গিয়েছি। উনি তখন অনেক কথা বললেন, এর মধ্যে একটা কথা ছিল– ‘জীবন খরচ করে কবিতা লিখতে হয়’। হেলাল ভাই তো শখে নয়, জীবন খরচ করেই কবিতা লিখেছেন।
প্রেস ক্লাবে শ্রদ্ধা জানাতে এসে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, আমাদের অনেক আন্দোলন সংগ্রামে হেলাল হাফিজের কবিতা দিয়ে স্লোগান তৈরি হয়েছে। ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ এই লাইন আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি নিভৃত জীবন কাটালেও কবিতা তাকে বর্ণাঢ্য এক জীবন দিয়েছে। তিনি লাখো মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।
হেলাল হাফিজ সবশেষ যে হোস্টেলে থাকতেন, সেই সুপার হোমের আরেক কক্ষের বাসিন্দা রূপম রোদ্দুর বলেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাদ যোহর দ্বিতীয় জানাজার পর হেলাল হাফিজের মৃতদেহ নিয়ে আসা হয় বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। পরে ৪টার দিকে দাফন সম্পন্ন হয়। এখানে পরিবারের সদস্যরা এবং কবির শুভাকাঙ্ক্ষীরা উপস্থিত ছিলেন।