‘আমরা নারী , আমরা সব পারি’– এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে দেশের নারীসমাজ আজ বীরদর্পে বিচরণ করছে সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে। তবে দেশে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়ন নারীর সংখ্যা এখনো অপ্রতুল। আর যে ক’জন ক্ষমতাপ্রাপ্ত নারী আমরা পাই, তারা চরম অবহেলা ও বঞ্চনায় পর্যুদস্ত বলে জানালেন নির্বাচন করে জিতে আসা তৃণমূল নারীরা। এই তৃণমূল নারীদের বঞ্চনা ও অবহেলার অবসানকল্পে দেশব্যাপী সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড এবং তাদের সংগঠিত করে অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে গঠন করা হয় অপরাজিতা নারী নেটওয়ার্ক। খান ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় এই নেটওয়ার্কের প্রক্রিয়া শুরু হয় চট্টগ্রামে ২০১১ সাল থেকে।
চট্টগ্রামের ২ টি জেলা, ৯ টি উপজেলা এবং ৯৫ টি ইউনিয়নে কাজ করছে অপরাজিতা নেটওয়ার্ক প্রকল্পটি। জাতিসংঘ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে নারীর ক্ষমতায়নকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিপাদ্য ছুঁড়ে দিতো। বিশ্বের নারীনেত্রীরা একত্র হয়ে নারীর পথচলার পথ মসৃণ করার জন্য নানা উদ্যোগ হাতে নিতেন। কালে কালে যুগে যুগে নারী তার ক্ষমতা পাওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করেন। আমাদের দেশে প্রথমবারের মতো ইউপি নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক নজীর সৃষ্টি করেন। এরপর থেকে সংরক্ষিত আসন না, সরাসরি নির্বাচনের দাবিতে নারী সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংসদে নারীদের কথা বলার পথ সুগম করেন। ইউপি সদস্যের পর প্রতিটি উপজেলায় একজন করে নারী ভাইস চেয়ারম্যান দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নকে এগিয়ে নিলেন আরেক ধাপ। কিন্তু প্রশ্ন আসে, এই যে ক্ষমতায়িত নারীরা তাদের সত্যিকারের ক্ষমতা কতটুকুনই প্রয়োগ করতে পারছেন। পারছেন না বেশির ভাগই। কারণ, তারা কাগজে কলমে আছেন, কাজে নেই। তাদেরকে কাজ দেয়া হয় না, দেয়া হয়না কোনো সুবিধাও। তাহলে এই বঞ্চনার গ্লানি নিয়ে তারা কেবল নামেই থাকবে, কাজে থাকবে না। এই বঞ্চনার জায়গাটাকে সত্যিকার অর্থে ফলপ্রসূ করতে এগিয়ে এসেছে খান ফাউন্ডেশন। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূল থেকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত নারীদের একই প্ল্যাটফরমে এনে নিজেদের অধিকার ও মর্যাদাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। প্রথমে উপজেলা কমিটি গঠন করে এই নেটওয়ার্ক তৃণমূল নারীদের সচেতন ক্ের তোলার উদ্যোগ নেন। এরপর জেলা পর্যায়ে একটি কমিটি গঠন করে এই প্ল্যাটফরমকে আরেকটু আপ গ্রেড করেন। অতি সম্প্রতি বিভাগীয় কমিটি গঠন করে তারা অপরাজিতাদের হাতকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেন। জেলা কমিটি গঠনকালে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা অপরাজিতাদের সাথে মতবিনিময় হয়, হয় শেয়ারিং। তারা সভায় তাদের বঞ্চনার করুণ চিত্রও তুলে ধরেন। পুরুষ মেম্বার আর চেয়ারম্যানরা তাদের সাথে কি ধরনের বৈষম্য আর বিভেদ সৃষ্টি করেন, তার বিস্তারিত বিবরণ দেন। কথায় কথায় উঠে আসে নানান চিত্র। সীতাকুণ্ড থেকে আগত এক অপরাজিতা আমাকে সাংবাদিক দেখে বলেন, আপা কোনো সমস্যা হলে আপনাকে ফোন দেবো। অন্য এলাকা থেকে আসা আরেকজন বলেন অন্য এক চিত্র। বিশেষ করে বিবাহ বিচ্ছেদ ও খোরপোষ সংক্রান্ত খবর। তিনি বলেন, আজকাল গ্রামে এক শ্রেণির মেয়ে একাধিক বিয়ে করে একাধিক জনের থেকে খোরপোষ আদায়ের ফাঁদ পেতেছে। এতে করে নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেরা বিপাকে পড়ছে। এ–প্রসঙ্গে উপস্থিত এক আইনজীবী বলেন, যেহেতু খোরপোষ দেয়াটা আইনসম্মত, এটি স্ট্রিক্টলি লেখা এক অনুচ্ছেদ। কাজেই বিচ্ছেদ হলেই , তাকে খোরপোষ দিতেই হবে। তবে যেসব মেয়ে এভাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে, তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা জরুরি।
আসলে যে–কোনো প্ল্যাটফরমে কথা বলতে গেলে অনেক কথা উঠে আসে। অপরাজিতা নারী নেটওয়ার্ক বিভাগীয় কমিটির সভাপতি নারী নেত্রী জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, অপরাজিতা নারী নেটওয়ার্ক দেশব্যাপী নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। আজ একবারে পাড়া গাঁয়ের একজন গৃহবধূ এসে এই প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে তাঁর অধিকার আদায়ে লড়াই আর সংগ্রামের কথা বলতে পারছে। তারা আজ সাহসী হয়ে উঠেছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে, উপজেলা পর্যায়ে নারী আজ এক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। কাজেই, এই অপরাজিতা নারী নেটওয়ার্ক নারীর ক্ষমতায়ন অর্জনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
একদা সংসদে ৩০ সেট অলংকার নিয়ে ‘যায় যায় দিন’ পত্রিকায় ছাপানো কভার স্টোরির কথা এখনো আমাদের মনে আছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংসদে প্রথম নারীদের জন্য ১০ টি আসন সংরক্ষিত রেখেছিলেন। ক্রমান্বয়ে তা বেড়ে ৩৩ টি করা হয়। তবে নারী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছিল, সংরক্ষিত আসন নয়, সরাসরি নির্বাচনের। এই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বর্তমানে ৫০ টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়। তবে, এখন নারীরা অনেক সাহসী হয়েছে, নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা আদায় করতে শিখেছে। এখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বুঝতে হবে নারীর বর্তমান চিত্র। নারী যে কাজ করছে। ৩ টি ইউনিয়ন মিলে একজন নারী মেম্বার, আবার ৩ টি ওয়ার্ড মিলে একজন কাউন্সিলর! এইটি কোন ধরনের কথা। একজন পুরুষ কাউন্সিলর একটি ওয়ার্ডে যা বরাদ্দ পাবেন, নারী কাউন্সিলর সেখানে ৩ টি ওয়ার্ড মিলে সেই বরাদ্দ পাবেন। পুরুষের ২ ভাগেরও কম একজন নারী পাচ্ছেন। সেটি কাম্য নয়। নারীদের এই জায়গায় কাজ করার পথ সুগম করতে হবে। বিশেষ করে রাজনীতিক কর্ণধারদেরকে আন্তরিকভাবে নারীদেরকে এই জায়গায় আনার কথা অবশ্যই ভাবতে হবে।