সামপ্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নারীরা নানা ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শারীরিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমাজে একদিকে উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটলেও নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য ও শোষণ অব্যাহত রয়েছে। কর্মক্ষেত্র, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনপরিসরে নারীরা প্রায়ই বৈষম্য ও নির্যাতনের সম্মুখীন হন। বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ এবং পারিবারিক নির্যাতন আজও আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। তাঁরা বলেন, নারী নিপীড়ন, শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের পাশাপাশি চুরি–ছিনতাই–ডাকাতির বেপরোয়া প্রবণতা নিঃসন্দেহে গভীর উদ্বেগের। এ পরিস্থিতি শঙ্কা ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে জনমনে। প্রতিদিন সংঘটিত এসব ঘটনায় স্বভাবতই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাজুক অবস্থা এবং জনপরিসরে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি যে অত্যন্ত ঝুঁকিতে পড়েছে, সে চিত্রই প্রকাশিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারও বেশ তৎপর ও সোচ্চার আমরা জানি। এরই মধ্যে তারা বেশ কিছু উদ্যোগ–পদক্ষেপ নিয়েছে। রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার স্বাভাবিক কার্যক্রম। এতকিছুর পরও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সৃষ্টি হয়েছে এক নৈরাজ্যকর অবস্থা। এটি নিঃসন্দেহে ভীতিকর।
নারীর প্রতি সহিংসতা যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেড়েছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না বলেই নারী ও শিশু লাঞ্ছনার ঘটনা বেড়ে চলেছে। ধর্ষণ বাড়ছে, বাড়ছে ধর্ষণের পর হত্যা। একই সঙ্গে বাড়ছে নিষ্ঠুরতা। বিচারহীনতা ধর্ষণকারীদের উৎসাহিত করছে। আকস্মিক এ ধরনের যৌন সন্ত্রাসের দৌরাত্ম্যে সর্বত্র উদ্বেগ নেমে এলেও পুলিশ হাঁটছে সেই পুরনো পথেই।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও আবাসন শুমারি ২০২২–এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা ৯৯। অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি অংশ নারীদের। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক, এই নারীরা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সামপ্রতিক সময়ে নারীর প্রতি নির্যাতনের প্রধান ধরনের মধ্যে ধর্ষণ সবার শীর্ষে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই সময়কালে দেশে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৭ হাজার ৪৭৯টি, যার মানে প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজারেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। একই সময়ে দেশে ৫৯ হাজার ৯৬০টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যা শুধু নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রাকে প্রকাশ করে না, বরং সামাজিক ও আইনি ব্যবস্থার অক্ষমতা এবং অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরে। ২০২৪ সালে যৌতুকের দাবিতে ৩৬ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন, যা সমাজ ও দেশের জন্য অত্যন্ত আশঙ্কার বিষয়।
দেশে কন্যাশিশুরাও নিরাপদ নয়। ২০২৪ সালে ২২৪টি কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যদিও অনেকেই মনে করেন, এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ, অধিকাংশ সময় শিশুরা এ ধরনের ঘটনাগুলো বর্ণনা করতে ভয় পায়। একই বছরে ধর্ষণের পর ৮১টি কন্যাশিশুর হত্যার ঘটনা ঘটে এবং ১৩৩টি কন্যাশিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক সমস্যা। মানুষের মধ্যে যে আদিম প্রবৃত্তি, তা দমিয়ে রাখতে হলে শৈশব থেকে বা পরবর্তীতে স্কুল কলেজে যথাযথ জ্ঞান চর্চা, নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনার মধ্যে সাইকোলজিক্যাল একটি ব্যাপারও কাজ করে। কোনো স্থানে একজন করলো, তা প্রচার হওয়ার পর দেখা যায়, এক নাগাড়ে এখানে ওখানে হতেই থাকে। এটা হয় কারণ, যাদের মধ্যে সেই আদিম মনোবৃত্তি দমানো যায়নি, তারা ঘটনার সংবাদটি জেনে উদ্বুদ্ধ হয়। অবদমিত প্রবৃত্তি তখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। এ ধরনের ঘটনা বাড়তে দিলেতো সামাজিকীকরণ থাকবে না। আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ হওয়া উচিত, পাশাপাশি পারিবারিক অনুশাসন ও মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কটা বাড়াতে হবে। তাঁরা বলেন, আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগটা হচ্ছে না। মূল্যবোধ, আদর্শের অবক্ষয় হচ্ছে। বিকৃত যৌন আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবারে অভিভাবকের শাসনটাও হচ্ছে না, শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যৌন শিক্ষার ধারণা না থাকায় যৌন আগ্রহটা বেশি। ধর্ষণের সময় ধর্ষক মনে করছে–আমরা এনজয় করছি।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ জাতীয় অপরাধ আগেও ঘটত। এখন তার কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকাশও পাচ্ছে ব্যাপক হারে। এ জন্য দায়ী অনেকগুলো ফ্যাক্ট। আর অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করায় ঘৃণিত এই সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিরোধ না করা গেলে সামনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।