নৃতত্ত্ববিদেরা মনে করেন, আজ থেকে প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে পোশাক পরিধান শুরু করেছিলো মানুষ। সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন পোশাক পরিধানের একটি ধরনও তৈরি হয়। ফলে মোটাদাগে না হলেও, অনেক সময় পরিধেয় দেখেও আমরা ধারণা করতে পারি যে ব্যক্তিটি কোন দেশ বা সমাজ বা অঞ্চলের। আবার পোশাক নির্বাচনে নারী ও পুরুষেরও রয়েছে আলাদা ধরন, যা কতকটা শারীরিক গড়নের ফলে নির্ধারিত হয়েছে, কতকটা সমাজ দ্বারা নির্ধারিত। এই নির্ধারণ বা নির্বাচন সমাজের একজন পুরুষ সদস্যকে যেমন কোনো বিপাকে ফেলে না, ঠিক তেমনি এর উল্টো পিঠে; সমাজের একজন নারী সদস্যকে প্রতিনিয়তই বিপাকে ফেলে।
একটা প্রশ্ন সামনে রেখে আলোচনাটি এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক। একজন নারী তার পরিধেয় নির্বাচনের সময় কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখেন? এই প্রসঙ্গে কয়েকটি চালু ভাবনা এই রকম যে, বাইরের লোকে কি বলবে…পরিবারের লোকেরা কি ভাববে…এটা তো আমার ধর্মীয়ভাবে নিষেধ…এটা তো আমার ধর্মে বলা আছে…হরেদরে এইসবই তো? অথচ ভাবার কথা ছিল এ-রকম যে, এই পোশাকটি পড়তে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, এই পোশাকটি আমার স্বকীয়তাকে তুলে ধরে ইত্যাদি। সাম্প্রতিক ‘টিপ’ কাণ্ডে, নারীর এই সাজ-পোশাক নির্বাচনের বিষয়টি আবারও আলোচনার তুঙ্গে।
প্রাসঙ্গিকভাবেই, দুটি প্রেক্ষাপট তুলে ধরছি। প্রেক্ষাপট এক, ধরুন আপনি রাস্তায় হাঁটছেন। আপনার পরনে সালোয়ার-কামিজ কিংবা শাড়ি, আপনার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অন্য একজন নারী আপনার ওড়না টেনে বা শাড়ির আঁচলটি টেনে আপনার মাথায় তুলে দিল। প্রেক্ষাপট দু্ই, গার্মেন্টসের ফ্লোরে নারী-পুরুষ উভয়েই কাজে ব্যস্ত, ভীষণ গরম পড়ছে। পুরুষ সহকর্মীদের অনেকেই শার্ট খুলে রেখে স্যাণ্ডো গেঞ্জি পড়েই দিব্যি কাজ করছেন। এদিকে সকল নারীকর্মীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। আশা করছি এই প্রেক্ষাপট দুটিতে যে চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি তা বিশদে বলার কিছু নেই।
আসলে নারীর পোশাক-কেন্দ্রিক যে সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়েছে সেটি বড় ধরনের একটি মনোজাগতিক বা চিন্তার সমস্যা। ফলে নারীর পোশাক নিয়ে মন্তব্য শুধু যে পুরুষদের দিক থেকে আসে তা-ই নয়, নারীরা অনেক সময় তীর্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দেন। বাংলাদেশে কোনো ধরনের পোশাকই আসলে নারীকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারে না যে কেউ তার পোশাক নিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে উঠবে না। তবে নারীর পোশাক বিষয়টি এভাবে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে মূলত সমাজ আর পরিবেশের প্রভাবে। গত কয়েক দশকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে যে ক’টি দেশে পোশাকের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে তার মধ্যে বাংলাদেশও একটি।
সামগ্রিকভাবে, নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রতি সম্মান আগেও কম ছিলো, এখন আরও কমেছে এবং সেটি পোশাকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে এটি এখন আরও দৃশ্যমান হয়েছে মাত্র। যেমন প্রায়ই চোখে পড়ে, হিজাব বা বোরকা পরলেই অনেকে ট্যাগ দেন এই নারী পশ্চাদপদ। আবার জিনস্-টপস্ পরলেও ট্যাগ দেয় বখে যাওয়া হিসেবে। ভারত-বাংলাদেশ তো বটেই, ইউরোপেও বাঙালি সমাজের সামনে ‘গা-খোলা’ পোশাক পরলে, পুরুষরা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এমনকি ফেসবুকে একটু খোলামেলা পোশাকের ছবি দিলে সেটিও ফেসবুক
কর্তৃপক্ষের খপ্পরে পরে, সেই ছবি মুছে দেয় বা ঢেকে দেয়! পাশাপাশি আমাদের দেশে সাইবার বুলিং তীব্র গতিতে বেড়ে চলেছে। নারী কেনো কোন পোশাক নির্বাচন করছেন তা নিয়ে চিন্তা না করেই পোশাক নিয়ে নিজের মতামতকেই চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা তাই সমাজে জোরালো হয়ে উঠছে।
অথচ এই বাংলাদেশেই ক’বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলে টি-শার্ট পরে হল অফিসে যাওয়া যাবে না এমন বিজ্ঞপ্তি দিয়েও তা তুলে নিতে হয়েছিলো কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু এই যে নারীর পোশাক নিয়ে এখন এতো আলোচনা, এটি কি কেবলই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে নাকি আসলে পোশাককেন্দ্রিক সামাজিক দ্বন্দ্বও প্রকট হয়ে উঠেছে? দু’হাজার পনের সালের দিকে বাংলাদেশের আদালত রায় দেয় যে, কাউকে ধর্মীয় কাজে বাধ্য করা যাবে না। অর্থাৎ কাউকে বোরকা পরতে বা রোজা রাখতে, এমনকি নামাজ পড়তেও বাধ্য করা যাবে না। গত কয়েক বছরে হিজাবের ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়েছেন বিচারকেরা, সেসব রায়ে বলা হয়েছে, কাউকেই তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে হিজাব পরতে বাধ্য করা যাবে না। কিন্তু আইনের সঙ্গে বাস্তবতার কি কোনো মিল খুঁজে পাই আমরা? পাই না, কারণ সমাজের একজন পুরুষ সদস্য একজন নারী সদস্যের টিপ পরিধানকে কটাক্ষ করছেন, জিন্স-টপ-টিশার্ট পড়া কাউকে ওড়না পড়তে উপদেশ দিচ্ছেন, সমাজের একজন নারী সদস্যই অপর নারী সদস্যের আঁচল সামলানোর দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছেন? এটা কি পুরুষতন্ত্রের আস্ফালন নয়? নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়? আমরা কি এখনে মধ্যযুগীয় চিন্তায় বসবাস করছি না?
এই মলিন সময়ে, তাই আসুন হাজার বছরের চাপিয়ে দেওয়া নিয়মকে নতুন করে সাজাই। সাজ-পোশাক সমাজের ঠিক করে দেওয়া ব্যবস্থাপত্র মেনে নয়, বরং হোক নারীর স্বাচ্ছন্দ্য আর ইচ্ছায় নির্ধারণ।