নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প দেখছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, আমাদের মেয়েদের কেবল ভুক্তভোগী হিসেবে না দেখে তাদের পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে তৈরি করতে হবে। গতকাল বুধবার ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘আইসিপিডি থার্টি গ্লোব্যাল ডায়ালগ অন ডেমোগ্রাফিক ডাইভার্সিটি অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তৃতা করছিলেন সরকারপ্রধান। এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। খবর বিডিনিউজের।
তিনি বলেন, বাল্য বিবাহ, যৌতুক ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। ২০১৪ সালে লন্ডন গার্লস সামিটে আমি বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলাম। সে লক্ষ্যে আমাদের কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে। বাল্যবিবাহ আইন সংশোধন, জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং নারী ও কন্যাশিশুদের কল্যাণে বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগের ফলে বাল্যবিবাহের হার বহুলাংশে কমেছে। আমরা ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ‘বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি’ গড়ে তুলেছি।শেখ হাসিনা বলেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরের কিশোর–কিশোরীদের নিয়ে ৮ হাজারের বেশি কিশোর–কিশোরী ক্লাব করা হয়েছে। ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের মাধ্যমে নারীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য এক কোটি নারীকে তথ্যসেবা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্প লাইন ‘১০৯’ চালুর মাধ্যমে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও বাল্যবিবাহ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানান, প্রতিটি থানায় নারী পুলিশের দায়িত্বে নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী সাপোর্ট ডেস্ক খোলা হয়েছে।
আমরা জাতীয় কৈশোর স্বাস্থ্য বিষয়ক কৌশলপত্র (২০১৭–২০৩০) এবং এর বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। কিশোর–কিশোরীদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে আমরা ১ হাজার ২৫৩টি ইউনিয়ন পর্যায়ের সেবা কেন্দ্রে কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্য সেবা কর্নার প্রতিষ্ঠা করেছি। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত প্রায় ৫০ লাখ কিশোরীকে বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের পুষ্টি চাহিদা পূরণে আমরা দেশব্যাপী ‘স্কুল মিল’ চালু করার উদ্যোগ নিয়েছি।
বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, উপবৃত্তি, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করার মত উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির ৪২.৬ শতাংশ নারী। এই হার ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
আইসিটি খাতের কর্মী বাহিনীতে ২০২৬ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কার্যক্রম নেওয়ার কথাও তিনি বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের গ্লোবালজেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৩ অনুযায়ী, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম এবং এ অঞ্চলে প্রথম। এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারী প্রতিযোগীদের অংশগ্রহণ আগের সাধারণ নির্বাচনের তুলনায় ৩৮.২৪ শতাংশ বেশি ছিল।
২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আমাদের জনগোষ্ঠীকে, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনগোষ্ঠীতে পরিণত করার জন্য ব্যাপক বিনিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ সংগ্রামের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতির পিতার নেওয়া পদক্ষেপ অনুসরণ করে সকলের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে নতুন জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন করি। বিশেষ করে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সেবার নিশ্চিত করার জন্য, তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছানোর জন্য সারাদেশে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন কাজ শুরু করি। সেই সময় জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচি গ্রহণ করি। নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে আমরা বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করি। নারী শিক্ষা বিস্তার এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তাদের অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে ছিল আমাদের আন্তরিক প্রয়াস।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ৭২ সালে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনস্বাস্থের উন্নতির জন্য রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেন। তার নির্দেশে ৭৩–৭৮ সালে পর্যন্ত প্রথম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনায় জনসংখ্যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তিনি একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ন্যাশনাল কাউন্সিল কমিশন গঠন করেন। জাতির পিতাকে হত্যা করার পরে এদেশে অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা আসে। এরপর সমস্ত অর্জনগুলো একে একে নষ্ট করে দেয়।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর সেসব অসমাপ্ত কাজ আবার শুরু করার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে পুনরায় সরকার পরিচালনার দায়িত্বে আসার পর আমরা আইসিপিডি প্রোগ্রাম অব অ্যাকশনের ১৫টি মূলনীতি বাস্তবায়নে জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ২০১২ প্রণয়ন করি। মাতৃমৃত্যু ও নবজাতক মৃত্যুহার হ্রাস, মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা, শিশু ও কিশোর–কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদানে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প পুনরায় চালু করি। বর্তমানে সারা দেশে সাড়ে ১৪ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে। এগুলোর মাধ্যমে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবাসহ ৩০টি অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা, বিশেষ করে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা খাতে আন্তর্জাতিক অর্থায়নের পরিমাণ ও সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য উন্নয়ন সহযোগী ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।