নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহক

অসাধু চক্রের হাতে জিম্মি ই-কমার্স খাত । আস্থা হারাচ্ছে সৎ উদ্যোক্তা ও সাধারণ মানুষ । এক মাসে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ৮শ অভিযোগ

ঋত্বিক নয়ন | রবিবার , ৫ মে, ২০২৪ at ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ

কর্মব্যস্ত নগরজীবনে সময়ের অভাব। আর তাই সময় বাঁচাতে ঘরে বসেই কেনাকাটার উপায় করে দিয়েছে অনলাইন শপিং সাইটগুলো। অনলাইনে কেনাকাটা এখন এতটাই সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তবে যেভাবে অনলাইন শপিং সাইট বাড়ছে, ঠিক তেমনি বাড়ছে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার ঘটনা। অনলাইন কেনাকাটায় বিভিন্নভাবে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহক। ইকমার্সের প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতা বা চাহিদাকে পুঁজি করে ব্যবসার নামে প্রতারণার জাল বুনেছে এক শ্রেণির অসাধু চক্র। অসাধু চক্র বিভিন্ন প্রলুব্ধকর বিজ্ঞাপনে সাধারণ গ্রাহককে আকৃষ্ট করে এক ধরনের পণ্য দেখিয়ে অন্য পণ্য কিংবা আসল পণ্যের মোড়কে নকল পণ্য সরবরাহ, কখনো পরিমাণে কম দেওয়া, আবার কখনো আগাম অর্থ নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়াএসব তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে দেশের ইকমার্সের ওপর। ফলস্বরূপ স্বস্তি ও আস্থার জায়গা হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে অনলাইন মার্কেটিং। অসাধু চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে ইকমার্স খাত। ফলে আস্থা হারাচ্ছে বহু সৎ উদ্যোক্তা ও সাধারণ মানুষ।

অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন অনলাইন মার্কেট প্লেস/শপে পোশাক, ইলেকট্রনিক পণ্য, খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন ভালো মানের পণ্যের ছবি ও বর্ণনা দিয়ে ছেঁড়া, নষ্ট, পচা বা নিম্নমানের পণ্য সরবরাহের কারণে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছে। ভুয়া কাস্টমার রিভিউর কারণে গ্রাহকদের সহজেই প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত সময়ের চেয়ে গ্রাহকের কাছে বিলম্বে পণ্য সরবরাহ করা হয়। মাঝেমধ্যে পেমেন্টের পর কাঙ্ক্ষিত পণ্য ডেলিভারি না দিয়ে গ্রাহকের নম্বর বা আইডি ব্লক করে দিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও পাওয়া যায়। অনেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কার্যালয়, শোরুম বা কাস্টমার সার্ভিস না থাকায় ক্রেতারা কেনাকাটার পরবর্তীতে বিক্রয়োত্তর সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠানকে বিশাল ছাড়, ক্যাশব্যাক ও বিভিন্ন ধরনের অফার দিয়ে গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করে প্রতারণা করতে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে কিছু প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রেতার কাছে পণ্য সরবরাহ করে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের পর বিপুল সংখ্যক ক্রেতার অর্থ হাতিয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার নজিরও রয়েছে।

ইলিশে বাড়ি চাঁদপুর’ নামে একটি ফেসবুক পেইজে মাছের ছবি ভিডিও দেখে ইলিশ মাছ কেনার অর্ডার করেন চট্টগ্রামের মিথিলা আফরিন (ছদ্মনাম) নামে এক গৃহবধূ। বলা হয় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্ডার ডেলিভারি দেওয়া হবে। মূল্য পড়বে সাড়ে চার হাজার টাকা। মিথিলা আজাদীকে জানান, তাদের কাছে আমি অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঁচশ টাকা অগ্রিম পাঠাই। পরদিন একটি নম্বর থেকে বলা হয়, কুরিয়ারে আমার মাছ এসেছে। চার হাজার টাকা পাঠালে ডেলিভারি দেওয়া হবে। তিনি বলেন, আমি মাছ দেখলাম না, কেন টাকা পাঠাব? তারা বললেন, এটাই সিস্টেম। নিরুপায় হয়ে চার হাজার টাকা, সাথে খরচ হিসেবে অতিরিক্ত আশি টাকা পাঠালাম। কিন্তু মাছ আসে না। যোগাযোগ করলে তারা হাস্যকর যুক্তি দেখায়। বলে, আশি টাকা বেশি পাঠিয়েছি, এটা নিয়ম নয়। করণীয় কী জানতে চাইলে বলে, এখন কিছু করার নেই, নতুন করে চার হাজার টাকা পাঠালে ডেলিভারি দেবে। আমি টাকা ফেরত পাঠাতে বললে তারা আমার নম্বরটা ব্লক করে দেয়।

অনলাইন শপিংয়ের নিয়মিত ক্রেতা আসফিয়া আম্ব্রিন জানান, প্রায়ই এমন হয়, যে রকম পণ্যের ছবি দেখে তারা অর্ডার করেছেন, সে রকম পণ্য পাঠানো হচ্ছে না। ক্ষেত্রভেদে খুবই নিম্নমানের পণ্য আসছে। পরে বাধ্য হয়ে পণ্যটি ফেরত পাঠাতে হয়। সেক্ষেত্রে ডেলিভারি চার্জটা গচ্চা যায়।

ফেসবুকে এমন অনেক পেজ আছে, যারা নিয়মিতভাবে ঠকাচ্ছে গ্রাহকদের, প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। পেজের অস্তিত্ব না থাকায় নেওয়া যাচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা। আর ভোক্তা প্রতারিত হলেও দায় নিতে চায় না ইকমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারিত হয়ে গত এক মাসে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ পড়েছে প্রায় ৮০০। গত বছরের তুলনায় এটা প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। তবে বেশিরভাগ ফেসবুক পেজের অস্তিত্ব কিংবা ঠিকানা না পাওয়ায় অভিযোগ নিষ্পত্তি হয় না।

ভোক্তার সচেতনতাই এ ধরনের প্রতারণা রুখতে পারে বলে জানায় বাংলাদেশ ইকমার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্যাব)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর শোভন বলেন, প্রতারকরা আইনের সীমাবদ্ধতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ভোক্তাদের সচেতন হতে হবে। কোনো কিছু অর্ডার করার আগে পেইজটির বয়স, রিভিউ ও পেমেন্ট সিস্টেম যাচাই করে নিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট বাদে লেনদেন করা যাবে না।

তিনি বলেন, প্রত্যেক উদ্যোক্তার ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন (ডিবিআইডি) নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। অথচ দাপ্তরিক নানা জটিলতায় অনেক উদ্যোক্তা আবেদন করেও সেটি পাচ্ছেন না। ফলে ডিবিআইডি অকার্যকর থেকে যায়। ডিবিআইডি কার্যকর থাকলে প্রতারণা অনেকটা কমে আসত বলে মনে করেন শোভন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতারণার বিষয়ে সচেতনতার বিকল্প নেই। অনলাইনে যেকোনো ধরনের কেনাকাটার ক্ষেত্রে ক্রেতাকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। কেনাকাটার সময় বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, ওয়েবসাইট/পেজের টজখ সংরক্ষণ করতে হবে; শপ/পেইজের স্ক্রিনশট, অর্থ পরিশোধ ও অর্ডার কনফার্ম সংক্রান্ত স্ক্রিনশট, চ্যাটিংয়ের স্ক্রিনশট সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতারণা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রমাণাদিসহ দ্রুত নিকটস্থ থানায় জিডি/অভিযোগ করতে হবে। পাশাপাশি, জিডি/অভিযোগের কপি নিয়ে ভুক্তভোগী আইনশৃক্সখলা বাহিনীগুলোর সাইবার সেলেরও সহায়তা নিতে পারেন। অপরাধীকে শনাক্ত করা গেলে পরবর্তীতে ভুক্তভোগীরা প্রতারকদের বিরুদ্ধে মামলা করার মাধ্যমে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারবেন। এছাড়া ভুক্তভোগী ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ বা আদালতে প্রতারণার মামলা করতে পারেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠায় বিশ্বব্যাপী ছাত্র-আন্দোলনে ছাত্রলীগের সংহতি
পরবর্তী নিবন্ধসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে আজ