নাজাতের উপায় তওবা ও ইস্তিগফার : তাওবাতুন নাসুহা বা একনিষ্ঠ তাওবা

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ১০ জুন, ২০২২ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল ও পরিভাষা হলো তাওবা। তাওবা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মানুষের জন্য বড় নেয়ামত, করুণা ও দয়া। এর মাধ্যমে মানুষ পাপ ও পঙ্কিলতা মোচন করে। পবিত্র কুরআনুল কারিমে মুমিনগণকে বারবার তাওবা ও ইস্তিগফার করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাওবা ও ইস্তিগফারের জন্য ক্ষমা, পুরস্কার ও মর্যাদা ছাড়াও জাগতিক উন্নতি ও বরকতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে বিভিন্ন হাদিসে ইস্তিগফারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি, ইস্তিগফার আল্লাহর অন্যতম জিকর। জিকরের সাধারণ ফজিলত ইস্তিগফারকারী লাভ করবেন। এ ছাড়াও ইস্তিগফারের অতিরিক্ত মর্যাদা ও সাওয়াব রয়েছে।

ইস্তিগফার শব্দের অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা করা। ইস্তিগফার শব্দটি মূলত মাগফিরাত শব্দ থেকে এসেছে ; যার শাব্দিক অর্থ ঢেকে দেওয়া, পর্দা করা। প্রকৃতপক্ষে বান্দা ইস্তিগফার করে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তায়ালা তাঁর পাপী বান্দাকে অনুগ্রহ ও ক্ষমার চাদরে ঢেকে দেন। তাওবার পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার নিকট লজ্জিত, অনুতপ্ত হয়ে অন্যায়-অসৎ কাজ থেকে প্রত্যাবর্তন এবং ভবিষ্যতের জন্য ন্যায় ও সৎ কাজের সংকল্প করা। অতঃপর সৎ কাজের দ্বারা অতীতের সব অসৎ কাজের ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করা। অর্থাৎ পাপের পথ ছেড়ে পুণ্যের পথে ফিরে আসা। সব তাওবাই ইস্তিগফার, সব ইস্তিগফার তাওবা নয়।
কাউকে শারীরিক-মানসিক কষ্ট দেওয়া, মান-সম্মান নষ্ট করা, দুর্নাম করা এবং মিথ্যা অপবাদ দেওয়া ও সম্পদ হানি করা-মানুষের হক নষ্ট করার অন্তর্ভুক্ত। কারও কোনো হক নষ্ট করে থাকলে যথাসম্ভব তার ক্ষতিপূরণ করতে হবে বা ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। আল্লাহর হকের মধ্যে কোনো হক (যেমন নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাত ইত্যাদি) বাকি থাকলে তা তাড়াতাড়ি আদায় করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন: হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট দৃষ্টান্তমূলক তাওবা করো। (সুরা-৬৬ তাহরিম,আয়াত : ৮)। আল কোরআনে আল্লাহ তাআলার ক্ষমার ঘোষণা : (হে রাসুল সা.) আপনি বলুন, হে আমার (আল্লাহর) বান্দাগণ! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করবেন। তিনি ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু। (সুরা-৩৯ জুমার,আয়াত : ৫৩)।

আল্লাহ তায়ালা সূরা আত-তাহরিমের ৮ নং আয়াতে বলেন, হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা করো, একনিষ্ঠভাবে তাওবা। আশা করা যায় এতে তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত। তাওবা জান্নাত প্রাপ্তি ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও ভালোবাসা লাভের একটি বড় সুযোগ ও উপায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ বেশি বেশি তাওবাকারীকে ভালোবাসেন। (সুরা বাকারা, আয়াত : ২২২)

তাওবাতুন নাসুহা বা একনিষ্ঠ তাওবার শর্ত : ১. পাপ কাজটি এক্ষুনি ছেড়ে দেয়া। ২. অতীত ভুলের জন্য লজ্জিত হয়ে কান্নাকাটি করা। ৩. ভবিষ্যতে পাপ কাজ না করার প্রতিজ্ঞা করা। ৪. বান্দার হকের সাথে সম্পৃক্ত বিষয় আদায় করে দেয়া। যেমন-ঋণ থাকলে আদায় করে দেয়া। আর জুলুম ও গীবত করলে ক্ষমা চেয়ে নেয়া। (মাআরিফুল কুরআন, পৃষ্ঠা-২৮২)

রাসূল সা: দৈনিক ১০০ বার তাওবা করতেন : রাসূলে আকরাম সা: হলেন মাছুম তথা নিষ্পাপ। তারপরও তিনি দৈনিক ৭০ বার, কোনো হাদিসে আছে ১০০ বার তাওবা-ইস্তিগফার করতেন। এটা উম্মতদের শিক্ষা দেয়ার জন্য। আর আমরা তো নিত্য গুনাহের মধ্যে ডুবে থাকি, তাহলে আমাদের কতবার তাওবা করা উচিত? আমরা ভেবে দেখেছি কখনো? হজরত আগার আল-মুজানি রা: থেকে বর্ণিত–রাসূল সা: বলেছেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা করো। আমি প্রতিদিন ১০০ বার তাওবা-ইস্তিগফার করি’। (সহিহ মুসলিম-২০৭৫,আবু দাউদ-১৫১৫)

আরেকটি হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, ‘আমি রাসূলে আকরাম সা: কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! অবশ্যই আমি প্রতিদিন ৭০ বারেরও অধিক আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তিগফার করি’। (সহিহ বুখারি-৫২৩২৪)

গুনাহগারদের মধ্যে তাওবাকারী সবচেয়ে উত্তম : হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত-রাসূলে আকরাম সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তানই গুনাহগার। আর গুনাহগারদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হলো তাওবাকারী’। (তিরমিজি-২৪৯৯,ইবনে মাজাহ-৪২৫১)

খাঁটি তাওবাকারীর কোনো গুনাহ থাকে না : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, ‘রাসূলে আকরাম সা: বলেছেন, গুনাহ হতে তাওবাকারী বান্দা এমন, যার কোনো গুনাহ নেই। (ইবনে মাজাহ-৪২৫০, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ-১৭৫২৬)

তাওবা ও ইস্তিগফার মানুষকে বিনয়ী করে : তাওবা ও ইস্তিগফার মানুষকে বিনয়ী করে তোলে, মানুষের পাপাচার মিটিয়ে মানুষকে পবিত্র করে তোলে। হাদিসে কুদসিতে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ বলেছেন, হে আমার বান্দারা! তোমরা দিবা-রাত্রি গুনাহ করে থাকো, আমি তোমাদের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেব। তোমরা ইস্তিগফার করো, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দেব’।-মুসলিম
দুই. আসতাগফিরুল্লাহ ওয়া আতুবু ইলাইহি।-বোখারি ও মুসলিম
তিন. আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম,ওয়া আতুবু ইলাইহি।-আবু দাউদ, তিরমিজি ও হাকেম
সায়্যিদুল ইস্তিগফার : আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি। লা ইলাহা ইল্লা আনতা। খালাকতানি ওয়া আনা আবদুকা। ওয়া আনা আলা আহদিকা। ওয়া ওয়াদিকা মাসতাতাতু। আউজু বিকা মিন শাররি মা-সানাতু। আবুয়ু লাকা বিনিমাতিকা আলাইয়্যা। ওয়া আবুয়ু লাকা বি জাম্বি। ফাগফিরলী। ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনবা ইল্লা আনতা।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় তেত্রিশবার সুবহানাল্লাহ, তেত্রিশবার আলহামদুলিল্লাহ, তেত্রিশবার আল্লাহু আকবার পড়ে এবং একশবার পূর্ণ করার জন্য একবার-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইইন কাদির-পড়ে তার সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয় যদিও তা সাগরের ফেনাপুঞ্জের সমান হয়’। (মুসলিম)।

বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফারের সুফল : মুমিন মাত্রই আল্লাহ তায়ালার কাছে বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করে। হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত আবদ ইবনে বসুর রা: থেকে বর্ণিত-রাসূলে আকরাম সা: বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে তার আমলনামায় অনেক বেশি ইস্তিগফার পেয়েছে’। (ইবনে মাজাহ-১২৫৪)
মাগফিরাত মানে ক্ষমা করা, গাফার ও গুফরান মানে ক্ষমা ; ইস্তিগফার মানে ক্ষমা চাওয়া ; তাওবা মানে ফিরে আসা বা ফিরে যাওয়া, প্রত্যাবর্তন করা, বিরত হওয়া। প্রথম মানুষ প্রথম ভুল করেছেন। সকল মানুষ ভুলকারী, তাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ হলো তওবাকারী। (বুখারি)। মোনাজাত অর্থ কানে কানে কথা বলা বা গোপনে কথা বলা। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, যে ব্যক্তি দিনে এই ইস্তিগফার পাঠ করবেন, সন্ধ্যার আগে তাঁর মৃত্যু হলে তিনি জান্নাতি ; যে ব্যক্তি রাতে এই ইস্তিগফার পাঠ করবেন, সকালের আগে তাঁর মৃত্যু হলে তিনি জান্নাতি। (বুখারি)।

তাই আসুন, তাওবা-ইস্তিগফারকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে নেই। আর শয়তানের খপ্পরে পড়ে কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়লে সাথে সাথে তাওবাতুন নাসুহা বা একনিষ্ঠ তাওবা করি। বেশি বেশি পড়ি, আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম,ওয়া আতুবু ইলাইহি।
লেখক : হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস , এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাবধানতাই পারে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঠেকাতে
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা