কোন অজুহাত ছাড়া জীবনে বাঁচুন, কোন অনুশোচনা ছাড়া ভ্রমণ করুন– অস্কার ওয়াইল্ড। প্রত্যেক মানুষের উচিত ভ্রমণ করা, কারণ স্থান পরিবর্তন মনকে নতুন শক্তি যোগায়, নতুন অভিজ্ঞতা দেয়। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় ও আত্মীয়তার বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ‘হোছাইন ফ্যামিলি’র এবারের পারিবারিক ভ্রমণ ছিল হাওরের দেশ কিশোরগঞ্জে। কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক স্থাপনা, নিকলী হাওর ও কিশোরগঞ্জ সদরে ভাতিজা শাকিলের শ্বশুরবাড়ি দেখার উদ্দেশ্যে। চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে তুর্ণা নিশীতায় পরিবারের চল্লিশ জনের বহর নিয়ে রওনা দিয়ে ভোর চারটায় ভৈরব পৌঁছি।
ভৈরব রেল স্টেশনে ঢাকা কিশোরগঞ্জ রুটে চলাচলের যাতায়াত পরিবহনের বিলাকারের বাস নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় ছিল শাকিলের বউ লুবনার বড় ভাই তুহিন। ভোরের আলো ফুটতেই মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পলিবিধৌত ভৈরবের রূপ দেখতে দেখতে সকাল আটটায় কিশোরগঞ্জ শহরের নগুয়ায় শাকিলের শশুরবাড়ি পৌঁছি। নতুন বেয়াই বাড়ি হিসেবে দুপুরের খাওয়ার আয়োজন ছিল বেশ জম্পেশ। বিকেলে সদলবলে বের হলাম সকালের সেই যাতায়াত বাস যোগে, পর্যায়ক্রমে দেখা হলো নরসুন্দা নদীর তীরে ঐতিহাসিক ‘শোলাকিয়া ঈদগাঁহ মাঠ, পাগলা মসজিদ, শহিদি মসজিদ ও মুক্তমঞ্চ। পরদিন সকালে নিকলী হাওরের উদ্দেশ্যে রওনা। প্রথমে বাসে করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখলায়। তারপর হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশি ভেদ করে ছুটে চলেছে আমাদের নৌকা। অন্যান্য পর্যটকদের নিয়ে পাশাপাশি ছুটে চলছে অনেকগুলো নৌকা। নৌকা চলা শুরু করা মাত্রই আমরা হারিয়ে যায় জলরাশির রাজ্যে। জলের সীমানা শেষ হতেই যেন বিস্তৃত আকাশ। দিগন্তে জলের বুকে দ্বীপের মত ভেসে থাকা ছোট ছোট গ্রাম, স্বচ্ছ জলরাশি, জেলেদের মাছ ধরার ব্যস্ততা। আমাদের নৌকা গিয়ে থামে ছাতির চরে। অর্ধ ডুবন্ত করচ ও হিজলের ফাঁকে স্থানীয় শিশু কিশোর গাছের বুক বরাবর পানিতে ভাসতে ভাসতে বিভিন্ন সওদা নিয়ে হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানায়। আমরাও ঝাঁক বেঁধে ছেলেদের সাথে নৌকা থেকে নেমে পরি। গাছের ফাঁকে ফাঁকে জলকেলী ও ফটোসেশন চলতে থাকে। সময় গড়িয়ে যায়, নৌকার মাঝির তাড়ায় নৌকায় উঠি সবাই। নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের নৌকা গিয়ে থামে মিঠামইন রাষ্ট্রপতি ঘাটে। নৌকা থেকে নেমে ঘাট সংলগ্ন দোকান থেকে সবার জন্য আইসক্রিম, জু্স ও আমড়া খাওয়া হয়ে গেল একদফা। মিঠামইনের পর্যটন স্পটগুলোয় ঘুরে দেখার জন্য সাত, আটটি ইজিবাইক ভাড়া করে হাওরের বিস্ময় ইটনা, মিঠামইন এবং অষ্টগ্রাম অলওয়েদার সড়ক, বড় ব্রিজ, জিরোপয়েন্ট, নিকলী বেড়ি বাঁধ ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বাড়ি। জিরোপয়েন্টে এসে দেখা একটি ঘোড়ার। আমার মেয়ে আনাবিয়া ও ছোট ছেলে আয়ান ঘোড়া চড়বেই, জিরোপয়েন্টের গোলচত্বরে এক চক্কর পঞ্চাশ টাকা– সাথে ঘোড়া সওয়ারী নিয়ে উপর দিকে এক জাম্ফ ফ্রি। হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশি দেখেই আমাদের ইজিবাইকগুলো থামে মিঠামইন বাজারে প্রসিদ্ধ পাঁচপোড়ন রেস্টুরেন্টের সামনে। দুপুরের খাবারের অর্ডার আগে থেকে করা ছিল। হাওরের মাছ, মুরগি ও ভর্তা দিয়ে দুপুরের খাবার সারলাম। তবে মিঠামইন–নিকলী ভ্রমণের পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে কড়া রোদে ফিরতি নৌকার যাত্রী। সমুদ্রের মতো বিশাল হাওর পাড়ি দিয়ে দিনের আলোয় বালিখলায়। একই বাসে কিশোরগঞ্জ শহরে। কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে আসা বিজয় এক্সপ্রেস ধরে চট্টগ্রাম।