ননাইয়া ননাইয়া-গানের বগী ভাই

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | সোমবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

ননাইয়া ননাইয়া কথা কই

এই মন কাড়ি লই

কথা নাই বার্তা নাই

ফডাস গরি কনডে গেলা গই

আঁই এখন থাইককুম কারে লই

ওয়েস্টার্ন ব্লুজ ঘরানায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গান। যেমন কথা। তেমন সুর। আর সবচেয়ে বড় বিস্ময় কণ্ঠ। কোনো রোমান্টিক গলা নয়। ওয়েস্টার্ন কাউবয় স্টাইলে গিটার বা মাউথ অর্গান বাজনায় যেমন গান গাইতে শুনি, তেমনই এক বিস্ময়কর কণ্ঠে এই গানটি গাইলেন বগী ভাই। বিস্ময়কর এই অর্থে, তখনও এরকম গলায় আমরা শুনতে অভ্যস্ত ছিলাম না। রেনেসাঁ ব্যান্ড এর ক্যাসেটে যখন এই গান শুনি, বেশ মজা পেতাম।

ননাইয়া ননাইয়া কথা কই

কিংবা

ফডাস গরি কনডে গেলা গই

এই লাইনগুলো গানের কথা হতে পারে, তা কখনো ভাবনার মধ্যেই ছিল না। শ্রদ্ধেয় শহীদ মাহমুদ জঙ্গী ভাইয়ের লেখা এবং শ্রদ্ধেয় নকীব ভাইয়ের সুরে এই অসাধারণ গানটি গেয়েছেন বগী ভাই। ফয়সল সিদ্দিকী বগী।

সেই বগী ভাইয়ের সাথে এক বিকেলে ঢাকায় তার বাসায় আলাপচারিতায় জানলাম ব্যতিক্রমী কণ্ঠের অধিকারী শিল্পীর নানান তথ্য।

বগী ভাইয়ের বেড়ে ওঠা নানার বাসায়। নানা উপমহাদেশের খ্যাতিমান শিল্পপতি, মন্ত্রী মরহুম এ.কে. খান। তিনি ছিলেন সংগীতানুরাগী এবং সংস্কৃতিবান। ফলে নানার বাসায় বিশ্ব সংগীতের আবহে। বড় মামা মরহুম জহির উদ্দীন খান বিদেশ থেকে আসার সময় লংপ্লে নিয়ে আসতেন। আর সেই লংপ্লের গান শুনে সংগীতানুরাগী হয়ে ওঠেন। পাশ্চাত্য গানের সুরে স্প্যানিশ গিটার বাজাতে থাকেন। বগী ভাইয়ের বাবা চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান বরেণ্য রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী যিনি এম.আর. সিদ্দিকী নামে পরিচিত। তিনিও ছিলেন সংগীতানুরাগী। তিনি শুনতেন শচীন কর্তার গান, বিশেষ করে এইচএমভি থেকে প্রকাশিত সেই সময়ের বাংলা গান। সুতরাং এমন সংগীত আবহে বেড়ে ওঠা বগী ভাই সংগীতের ভুবনে ভ্রমণ যাত্রা শুরু করেন।

চট্টগ্রামের সেন্ট মেরী’স স্কুল, সেন্ট প্লাসিড স্কুল, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পড়েছেন। পরে ঢাকায় সেন্ট জোসেফ স্কুল থেকে ও লেভেল পাশ করেন। ১৯৭৩ সালে ঢাকায় পড়াকালীন সময়ে বগী ভাই একটি ব্যান্ড গড়েছিলেন। নাম: Abnormal…. তাঁর সাথে ছিলেন কাজী শাকিল জয় (ফুটবলার সালাউদ্দিনের ছোট ভাই), বাদল, তুষান। ঐ সময়ে ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে, ছোটখাটো অনুষ্ঠান করেছে Abnormal ব্যান্ড ।

পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে বগী ভাই উচ্চ শিক্ষা নিতে চলে যান ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৮০ সালে দেশে ফিরে এলেন। ১৯৮১ সালে আবার চলে গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৮২ সালে দেশে ফিরে এলেন। সংগীতচর্চায় সাময়িক বিরতি ছিল। এবার দেশে ফিরেই আবারও সংগীতচর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ছোটমামা জিয়াউদ্দীন খান

(পাবলো) পরিচয় করিয়ে দিলেন দেশের বরেণ্য সংগীত শিল্পী নকীব খানের সাথে। ঐ সময়ে নকীব খান ও শাহবাজ খান পিলু ঢাকাবাসী। তারা সমমনা সংগীতশিল্পীদের নিয়ে গান চর্চা করছেন। গড়েছেন ব্যান্ড ‘রেনেসাঁ’। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে বগী যুক্ত হলেন রেনেসাঁর সাথে। সাথে যুক্ত হলেন এহসানুল ইসলাম মোটো এবং ডা. মামুন। সাল ১৯৮৫।

রেনেসাঁ’র প্রথম ক্যাসেটে বগী ভাইয়ের লেখা, সুর ও কণ্ঠে তিনটি গান আছে। গান তিনটি হচ্ছে : Happy Feeling , Rock and Renaissance Subolong.

এরমধ্যেই পরিচয় হলো দেশের বরেণ্য গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী ভাইয়ের সাথে। তিনি একদিন বগী ভাইকে বাংলা গান গাইতে পরামর্শ দিলেন। জঙ্গী ভাইয়ের এই পরামর্শে উৎসাহিত হলেন বাংলা গান গাইতে।

প্রথম বাংলা গান কিভাবে গাইলেন? শুরুটা কীভাবে হলো? এই বিষয়ে বগী ভাই বললেন: রেনেসাঁ ব্যান্ডের সাথে একটি কনসার্টে সিলেট গিয়েছি। বিকেলে চা বাগানে নকীব ভাই তাঁর সদ্য সুর তোলা গান ‘হৃদয় কাদামাটির কোনো মূর্তি নয়’ শোনাচ্ছেন। শুনেই আমার কাছে খুব ভালো লাগলো এবং বলি এই গানটি আমি গাইবো। আমার কেন জানি মনে হলো গানটি হিট হবে। পরে আমি এই গানটি গাইলাম। গানের কথাও সুন্দর। সামাজিক বক্তব্যধর্মী এই গানটি আমার প্রিয় গান। উল্লেখ্য, এই গানটি লিখেছেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। নকীব খানের সুরে গানটির কথা এমন :

হৃদয় কাদামাটির কোনো মূর্তি নয়

আঘাত দিলে ভেঙে যাবে

মন উড়ন্ত কোনো বেলুন নয়

হুল ফুটালে চুপসে যাবে

শুকনো মাঠে ফুল ফুটানোর সারাবেলার খেলা

শূন্যতার মাঝে গড়ি

বিনিসুতোর মেলা

বুকের মাঝে ভালোবাসা

থাকবে জীবনময়

অন্তচক্ষু খোলা রাখি সবই আমি দেখি

সাধ্যি কার এই ভুবনে দেবে আমায় ফাঁকি

বুকের মাঝে ভালোবাসা

থাকবে জীবনময়।

গানটি রিলিজের পর ভীষণ জনপ্রিয় হয়। বগী ভাইয়ের অনুমান সঠিক হলো। ব্যতিক্রমী কথা, সুর ও গায়কীতে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হলো।

বগী ভাইয়ের আরেকটি গান ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে। সেটি হলো :

ননাইয়া ননাইয়া কথা কই

এই মন কাড়ি লই। ’

এই গানটিও লিখেছেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। সুর করেছেন নকীব খান। বগী ভাইয়ের গাওয়া এই দুইটি বাংলা গান আজও জনপ্রিয়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গান গাওয়ার বিষয়ে বগী ভাই জানালেন: ইংরেজি গান কিংবা শুদ্ধ ভাষায় বাংলা গান গাওয়ার চাইতে চাটগাঁইয়া ভাষায় গান গাইতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বাসায় ছোটবেলা থেকেই এই ভাষায় কথা বলে আসছি। চট্টগ্রামবাসীদের সাথে এই ভাষায় কথা বলতেই বলি। তাই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গান গাইতেও ভালো লাগে। ‘ননাইয়া ননাইয়া কথা কই ’ গানটিও যে হিট হয়েছেতা খুব উপভোগ করি আজও।

ফয়সল সিদ্দিকী বগীর গাওয়া এই দুইটি গানেরই সুরকার নকীব খান। নকীব খানের কাছে জানতে চেয়েছি, ভিন্নধর্মী গান দুটো বগী ভাইকে দিয়ে গাওয়ানোর কারণ কী? নকীব খান বললেন: বগী ভাইয়ের কণ্ঠ ভিন্ন। গতানুগতিক ধারার নয়। আর আমিও এই ধরনের কাজকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। বরাবরই আমি গানে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করি। আজও গান দুটো গাইছে এই প্রজন্মের শিল্পীরা। ভালো লাগছে।

ফয়সল সিদ্দিকী বগী পরবর্তীতে ‘একতার’ নামে একটি মিউজিক কোম্পানি গড়েন। ‘একতার’ থেকেই সংগীতশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন হায়দার হোসেন, হাবীব ওয়াহিদ, পথিক নবী, সায়ান চৌধুরী অর্ণব, সন্দীপন, বাংলা ব্যান্ড। ‘একতার’ নিয়েই এখন ব্যস্ত এই গুণী শিল্পী। নিভৃতচারী মানুষ ফয়সল সিদ্দিকী বগী। তাই বগী ভাইয়ের সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিলাম। সুরকার ও গায়ক শাহবাজ খান পিলু ভাইয়ের সাথে কথা প্রসঙ্গে বগী ভাইয়ের বিষয়টি বলি। অবশেষে পিলু ভাইয়ের সূত্রে পেয়ে গেলাম ‘ননাইয়া ননাইয়া’ এবং ‘হৃদয় কাদামাটির কোনো মূর্তি নয়’ গানের প্রিয় শিল্পীকে। পরিশেষে বলি: ‘ভালা থাইক্কুন বগী বদ্দা’।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশান্তিপুরা শ্রী লঙ্কার সবচেয়ে উঁচু গ্রামে
পরবর্তী নিবন্ধমাইজভাণ্ডারী দর্শন শীর্ষক সেমিনার ২০ ডিসেম্বর