নদী জীবিত সত্তা : নদী বাঁচান, দেশ বাঁচান

ড. আবদুল আজিম শাহ্‌ | মঙ্গলবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

প্রকৃতির পঞ্চতত্ত্বের মধ্যে অন্যতম উপাদান পানি। পানি উৎপত্তির স্রোতধারা হল নদী। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে উৎপত্তি হয়ে ঝর্ণাধারায় পতিত প্রবহমান ধারার নাম নদী। নদী অর্থ ব্যক্ত। যে কল কল শব্দে নিজেকে ব্যক্ত করে দেশের আনাচেকানাচে প্রবাহিত হয়। নদী ব্যক্ত হয়ে সমগ্র দেশের আনাচেকানাচে আপন গতিতে বয়ে বেড়ায়। নদীর রয়েছে বহু বৈচিত্র্যতা। এর উপর নির্ভর করে ওই অঞ্চলের সংস্কৃতি, জীবনাচরণ। নদী প্রাণদায়ক জীবিত সত্তা। নদীর প্রাকৃতিক ভাইব্রেশনের উপর স্থানীয়দের মানসিকতা নির্ভর করে। নদী সচ্ছল, যৌবনে ভরা ও প্রবহমান থাকলে স্থানীয় মানুষের মনোপ্রকৃতি উদার হয়। নদীসত্তার পঙ্গুত্ব কিংবা মৃত্যুর সাথে সাথে স্থানীয় সংস্কৃতিরও মৃত্যু ঘটে।

নদী আল্লাহর ইশারায় নিজস্ব গতিতে প্রবহমান। ধ্বনি থেকে সমগ্র সৃষ্টি। যেখানে গতি, সেখানেই ধ্বনি। প্রত্যেক বস্তুরই নির্দিষ্ট গতি রয়েছে। গাড়ি চলেতার গতি রয়েছে, গতির ফলে শব্দ উৎপন্ন হয়। ফ্যান চলে সেখানেও গতি। ফলে ধ্বনি বের হয়। শ্বাসপ্রশ্বাস নিই, সেখানেও গতি, শরীরে রক্ত সঞ্চালন হয়, পিঁপড়া চলে, সেখানেও গতি রয়েছে; যা আমাদের শ্রবণক্ষমতার তুলনায় অনেক নিচে। যেখানে ধ্বনি সেখানে প্রাণ। নদীও কলকল শব্দে আপন গতিতে শাখাপ্রশাখা সৃষ্টি করে আল্লাহর ইশারায় দেশের আনাচেকানাচে বয়ে চলে। প্রবহমান নদী ভূমিকে উর্বর করে। এবং সজীব সহ সমগ্র দেশকে পবিত্র ও প্রশান্তিতে রাখে। জলের প্রবাহ দেহ ও মনকে পবিত্র করে। মানবদেহের শিরাউপশিরার মত নদীও দেশের শিরা উপশিরা। দেহের রক্তনালির কোথাও যদি ব্লক হয়, হার্টব্লক হয়ে হার্ট অ্যাটাক, মাথায় ব্লক হলে ব্রেনস্ট্রোক, ব্রেন হেমারেজ, প্যারালাইসিসসহ সর্বোপরি মৃত্যুও হতে পারে।

তদ্রূপ একটি দেশের প্রাণ হলো নদী। নদীপ্রবাহ রক্তের শিরাউপশিরার মত। নদীপ্রবাহকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হয়। জোরপূর্বক নদী বন্ধন করা মানে গলা টিপে হত্যার শামিল। নদীতে বাঁধ নির্মাণে প্রথমত নদীর কলকল ধ্বনি বন্ধ হয়, পানির গতি ব্যাহত হয়। মাসে তিন থেকে চার দিন ঋতুস্রাবের মাধ্যমে নারী যেভাবে শুদ্ধ ও পবিত্র হয়; তদ্রূপ নদী বেগের মাধ্যমে পরিশোধিত ও পবিত্র হয়। সর্বশেষে সমুদ্রে গিয়ে বিশ্রাম নেয়। বাঁধ দেওয়ায় পানির অবকাঠামো নষ্ট হয়। দ্রবীভূত অক্সিজেন ধ্বংস হয়।

ফলে মানবদেহের মতো ব্লক হয়ে দেশ পঙ্গু হয়ে যাবে। ভূমির উর্বরতা নষ্ট হবে। পানি যতক্ষণ একসঙ্গে থাকে, ততক্ষণ গুণাগুণ বজায় থাকে। যখন মূল থেকে, গতি ও নিজস্ব ধারা থেকে পৃথক হয়, তখন গুণাগুণ নষ্ট হয়। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু (এই জীবিত সত্তা) নদীকে নদীবন্ধন সহ বিভিন্নভাবে দূষণ করে মেরে ফেলছি।

যেরকম প্রত্যেক মানুষের রক্তের একটা ইকোসিস্টেম আছে, কখনো A+ (Positive)-এর সাথে B+ (Positive) রক্তের ম্যাচিং হয় না। ম্যাচিং না হওয়া সত্ত্বেও যদি শরীরে রক্ত প্রবেশ করানো হয়, তাহলে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তদ্রুপ বাঁধ দিয়ে নদীকে পৃথক করা যায় না, আবার জোরপূর্বক এক নদীর সঙ্গে অন্য নদীর ধারাও এক করা যায় না। কারণ প্রত্যেকটি নদীর নিজস্ব ইকোসিস্টেম আছে। জোরপূর্বক নদীর গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন করলেও একই সমস্যা হয়। সমুদ্রে বাঁধ নির্মাণ করে সৃষ্টিশীল কোনো কাজ করা যায়, কিন্তু নদীতে বাঁধ দেওয়া যায় না। এটি প্রকৃতিবিরোধী কাজ। নদীতে বাঁধ দিলে কলকল ধ্বনি বন্ধ হয়ে যায়। এতে সৃষ্টির বিকৃতি সহ প্রকৃতির ছন্দ পতন হয়। নদী তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। তাই প্রকৃতির কাজে বাধা দিতে নেই। প্রকৃতির মাঝে স্রষ্টার অস্তিত্ব বিদ্যমান। কারণ, প্রকৃতির মাঝে স্রষ্টা ণধহম ঈধঃধষুঃরপ অমবহঃ হিসেবে কাজ করে। প্রকৃতি আমাদের প্রতিনিয়ত সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা ক্ষতি করছি। ফলে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। পরোক্ষভাবে স্রষ্টাকেই অস্বীকার করছি। নদী বন্ধনের মাধ্যমে প্রকৃতির কাজে বাধা দেওয়া মানে আল্লাহর কাজে বাধা দেওয়া। পানিতে বাঁধপ্রথা ব্রিটিশদের সৃষ্ট। ১৭৮৬ সালে ভারতে, ব্রিটিশরা প্রথম কাবেরী নদীতে বাঁধ নির্মাণ করেন। এর পূর্বে ভারতবর্ষে কোনো নদীবন্ধন ছিল না। কারণ প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের মানুষ প্রকৃতি বিরোধী কাজ করতেন না। তারা প্রকৃতির প্রতি সহনশীল ছিল।

বিবেচনাহীন নদীবন্ধনের ফলে ধ্বংস হচ্ছে হাজার হাজার প্রাণী, বাসস্থান, চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কৃষিজমি। বাঁধের এক পাশে জলাধার, অন্য পাশে নদী শুকিয়ে হচ্ছে ধুধু মাঠ। মানবদেহের নিম্নাঙ্গের দিকে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বন্ধ করে, উপরের দিকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিচর্যা করলে যেভাবে কোনো উপকার আসে না বরং ক্ষতি হয় ; তদ্রুপ নদীর এক পাশে পানি রাখবেন, আর নদী বন্ধন করে অন্য পাশে শুকিয়ে ফেলবেন, তাহলে পুরো নদীই ধ্বংস হয়ে যাবে। জোরপূর্বক থামাতে গেলে নিজেদেরই ক্ষতি হয়। লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়। কৃষ্টিকালচার ফেলে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়। লক্ষ লক্ষ গাছ ধ্বংস হয়। বাঁধের ফলে বদলে যায় ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক পরিবেশ। ফারাক্কা বাঁধের ফলে রাজশাহীসহ উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত কৃষিজমি পরিণত হচ্ছে মরুভূমিতে। আবার হঠাৎ বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়ার ফলে অসময়ে বন্যায় প্লাবিত হয়। এছাড়া টিফাইমুখ বাঁধ, তিস্তা নদীর বাঁধের ফলে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে ভয়াবহ বিপদের সামনে। নদী তার নিজস্ব গতিপ্রকৃতিতে চলবে, এটাই চিরাচরিত নিয়ম। প্রকৃতি স্রষ্টার ইশারায় পরিচালিত হয়, তাও মানুষের কল্যাণে, কিন্তু তাকেই দূষিত করছে। এটা চরম গর্হিত কাজ। এসব বাঁধ নির্মাণ না করলে নদীর গতিপ্রকৃতি যেমন ঠিক থাকত, তেমনি পানির সুষম বণ্টনের মাধ্যমে বাংলাদেশও উপকৃত হতো। বৈশ্বিক এই ক্রান্তিলগ্নে সম্পদেরও সুষম বণ্টন হতো। পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সবসময় সুসম্পর্কসহ সবাই একটা পরিবারের মতো থাকত। ধীরে ধীরে নদীসমূহ মরে যাচ্ছে।

১৯৬২ সালে কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মিত হয়। (পরিসংখ্যানে জানা যায়) এর ফলে ৫৪০০০ একরের মতো কৃষিজমি পানিতে তলিয়ে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়। ২৩৪ বর্গমাইল বনাঞ্চল ধ্বংস হয়, লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, তারা তাদের কৃষ্টিসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়। চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ি পানিতে তলিয়ে যায়। এ অঞ্চলের মানুষের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, এই ক্ষোভ এখনো বিরাজমান!

বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদীর সাথে জড়িত আছে (প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্রের আধার) হালদা নদী। কর্ণফুলীর তীরে গড়ে উঠেছে প্রচুর শিল্পকারখানা। এসব কারখানা থেকেই ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্য কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে পড়ে। নদীতে মিশে পানির অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস করে। অক্সিজেন লেভেল ৩ পিপিএম এ নেমে আসলে মাছের ডিম পরিস্ফুটনে সমস্যা হয়। চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত কারখানাগুলোর বর্জ্যও নর্দমার মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীতে পড়ে। চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই খালের কথা নাই বললাম। দেখে মনে হয়, এর উৎপত্তিই হয়েছে বর্জ্য ফেলার জন্য। এটা দূষিত হতে হতে আর খালের পর্যায়ে নেই। ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। একসময়ের বিশুদ্ধ বুড়িগঙ্গা নদীই এখন দেশের অন্যতম প্রধান দূষিত নদী। যার তীরে তিল তিল করে ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে, সেই নদীকেই দূষণ করতে করতে নদীর গাঁয়ে ক্ষত সৃষ্টি সহ মুমূর্ষ বানিয়ে ফেলেছে।

বেশিভাগ শিল্পকারখানায় বর্জ্যপদার্থ পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। যে কয়টিতে আছে, তাও লোক দেখানো। তাই বর্জ্য নদীতে পতিত করার পূর্বেই বৈজ্ঞানিক উপায়ে শক্তিতে রূপান্তর করে নদীকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জাহাজকাটা শিল্পে বিদেশ থেকে পরিত্যক্ত জাহাজ এনে কর্তন করা হয়। এগুলোতে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা খুবই ক্ষতিকর। এসব বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি পানিকে দূষিত করে। তবে এর ব্যতিক্রমও লক্ষণীয়। ‘সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীতে পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড মাটি ও পানি দূষণ মুক্ত রাখার জন্য পরিবেশবান্ধব আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। জাহাজে যেসব রাসায়নিক বর্জ্য থাকে, সেগুলো পানি, বায়ু, মাটি,তথা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ থেকে রক্ষার জন্য গড়ে তুলেছে বর্জ্য সংরক্ষণাগার। বর্জ্য ইয়ার্ড থেকে বের হওয়ার আগেই কয়েক দফা পরীক্ষা করা হয়, যেন ক্ষতিকারক পদার্থ না থাকে। এবং বৃষ্টির সাথে যাতে সমুদ্রে না যায়, সেই ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ’। (তথ্যসূত্র: দৈনিক পূর্বকোণ, ৩ জানুয়ারী ২০২১)

প্রকৃতি স্বয়ং নিজেকে নিজেই পরিশুদ্ধ করে। নদীও তাই। প্রকৃতি কারো বিনিময়ে আশা করে না। শুধু আশা করে যেভাবে আছে সেভাবে টিকে থাকার নিশ্চয়তা। আর এই নিশ্চয়তা বিধান রাষ্ট্রসহ সকলের নৈতিক দায়িত্ব। তাই নদী বাঁচান, নিজে বাঁচুন, দেশকে বাঁচান। প্রকৃতির প্রতি সদয় হয়ে আল্লাহর অনুগ্রহ হাসিল করুন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক। সাজ্জাদানশীন, মতিভাণ্ডার দরবার শরিফ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষ মানুষের কাছে নিরাপদ হোক
পরবর্তী নিবন্ধজনসভা-পথসভার উন্মুক্ত প্রান্তরগুলো