আদিকাল হতে যতসব সভ্যতা, নগর মহানগর গড়ে উঠেছে তা নদী–সাগর–মহাসাগরকে ঘিরে। কর্ণফুলী নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে উপমহাদেশের বাণিজ্যিক হাব হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম বন্দর। ঐতিহাসিক ও সমৃদ্ধশালী চট্টগ্রাম বন্দর বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে গড়ে উঠেছে।
চতুর্দশ শতকে চট্টগ্রামে মুসলিম রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ এর আমল থেকেই কর্ণফুলীর পাড়ে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বন্দরের খ্যাতি দেশে–বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম বন্দর সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে এক বিরাট সমুদ্রের তীরে চট্টগ্রাম এক বিরাট ব্যবসাকেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ বন্দর’।
ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম পরিভ্রমণের প্রায় ষাট বছর পর ১৪০৫ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করেছিল চীনা বাণিজ্য জাহাজ (চীন সম্রাট ইয়ং লোর রাজত্বকালে)। ডি. ব্যারোস এর লিখিত বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে মাহামুদ শাহের রাজত্বকালে গোয়ার গভর্ণর নুনো দ্য কুনহার আদেশে অ্যালফন্সো–ডি–মেলো চট্টগ্রাম আসার পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্তুগিজদের একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং পোর্টো গ্র্যান্ডো নাম ধারণ করে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে শুরু হয় বহিঃবিশ্বের সঙ্গে বিপুল পরিমাণে মাল আমাদিন প্রক্রিয়া।
চট্টগ্রামের আধুনিক যে বন্দর ব্যবস্থাপনা তা বর্তমানে বিশ্বের সাথে সমতালে এগিয়ে চলছে। চট্টগ্রামের যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও অর্জন তা এ বন্দরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে।
কর্ণফুলী নদী সারা দেশ থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কঙবাজারকে আলাদা করেছে। প্রায় ৯১ বছর আগে এ নদীর উপর প্রথম কালুরঘাট রেল সেতু নির্মাণ করা হয়। এই সেতু থেকে সাত কিলোমিটার ভাটিতে ১৯৮০ সালে প্রথম সড়ক সেতু নির্মাণ হয়। ২০১০ সালে কর্ণফুলী তৃতীয় সেতু ‘শাহ আমানত সেতু’ নির্মাণ হয়। বন্দর সংশ্লিষ্টতার কারণে শাহ আমানত সেতু থেকে নদীর মোহনা পর্যন্ত নতুন করে সেতু নির্মাণের কোনও সুযোগ নেই। ফলে এই সেতুর ২১ কিলোমিটার ভাটিতে কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে নদীর তলদেশে নির্মাণ করা হয়েছে কর্ণফুলী টানেল। যার নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’। যা আধুনিক বিশ্বের চলমান উন্নয়নের সাথে যুক্ত করেছে বাংলাদেশকে।
বর্তমান সরকারের বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সুড়ঙ্গ সড়ক (বঙ্গবন্ধু টানেল) নির্মাণ প্রকল্প, যা উপমহাদেশে প্রথম। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পরিকল্পিতভাবে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে চট্টগ্রাম নগরীকে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ আদলে গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে।
স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে নদীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা, কর্ণফুলী, পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস দেখা যাচ্ছে। এ টানেল ধরেই কঙবাজার পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ উন্নত হচ্ছে এবং পাশাপাশি রেল সংযোগেও যুগান্তকারী সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। নির্মাণাধীন সড়কের দুই পাশেই শিল্পকারখানা এবং আবাসনের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইতোপূর্বে কর্ণফুলীর উত্তরপাড়ে চট্টগ্রাম মহানগর আর টানেল নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় দক্ষিণপাড়ও দ্রুতই রূপ পেতে যাচ্ছে শহরে। তারই ধারাবাহিকতায় নতুন করে চট্টগ্রাম মহানগর মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। এতে করে বিস্তৃত হবে মহানগরীর আয়তন এবং নদীর দক্ষিণপাড়েও আনোয়ারায় রয়েছে কাফকো (কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানী লিমিটেড), সিইউএফএল (চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড), কোরিয়ান ইপিজেড এবং বিভিন্ন ভারি শিল্পকারখানা। বঙ্গবন্ধু টানেল সেখানে শিল্পায়নের গতিকে আরও বেগবান করবে। চায়না ইকোনমিক জোন বাস্তবায়নের বড় একটি ধাপ এগিয়ে দেবে এই টানেল। কেননা, এর মাধ্যমে সুগম হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে আনোয়ারা উপজেলা নতুন করে রূপ পাচ্ছে উপশহরে। পরিবর্তন ঘটছে এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায়। ভৌগোলিক কারণে একদিকে সমুদ্রবন্দর, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের ফলে আনোয়ারা হবে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ এক মাধ্যম। বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠছে নতুন নতুন স্থাপনা, দোকানপাট, শপিংমল ও অসংখ্য অভিজাত রেস্টুরেন্ট। টানেলের কারণেই নতুন করে সৃষ্টি হবে আর্থ–সামাজিক অবস্থান। বাড়বে দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব্যাংকিং এবং অর্থনৈতিক সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এইচএসবিসি গ্লোবাল রির্সাচ প্রকাশিত ‘দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান’ এর ‘এশিয়া’স শপার্স ইন ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যমতে বাংলাদেশের কনজিউমার মার্কেট যুক্তরাজ্যকে ছাড়িয়ে যাবে। এ পর্যন্ত বাঙালির যত অর্জন তা বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু পরিবার ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই অর্জিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদেরকে একটি জাতীয়তা দিয়েছেন, দিয়েছেন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছে গণতন্ত্র, উন্নয়ন আর অগ্রগতি। ‘তাই বাংলার মানুষ আজ হৃদয়ের গভীর থেকে বিশ্বাস করে–শেখ হাসিনার সরকার, বারবার দরকার। যতদিন শেখ হাসিনার হাতে থাকবে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ।’
সভ্যতার অগ্রগতির পথ সুগম করেছে সামুদ্রিক বাণিজ্য। পরিবহনের জন্য সমুদ্রের গুরুত্ব চিরকালই ছিল, এখনো আছে। তবে শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষের কাছে সামুদ্রিক সম্পদের অফুরন্ত সম্ভাবনা ও গুরুত্ব তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকৃতি ও সমুদ্রকে মানুষ গভীরভাবে জানতে পারছে। সাগরের সীমানায় বাংলাদেশের মালিকানা প্রতিষ্ঠা হলেও এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে সমুদ্র বক্ষের বিপুল পরিমাণ সম্পদ। দেশের সমুদ্রসীমায় যেসব অনাবিষ্কৃত সমুদ্রসম্পদ রয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সেগুলোর সংগ্রহ এবং টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। মাছ এবং খনিজ সম্পদ আহরণের পাশাপাশি নিজেদের সমুদ্রসম্পদ যথাযথ ব্যবহার করে পাল্টে দেওয়া যেতে পারে দেশের অর্থনীতির চিত্র। এজন্য চাই নিজস্ব দক্ষ জনশক্তি ও প্রযুক্তি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু সামুদ্রিক মাছ ও শৈবাল রপ্তানি করে বাংলাদেশের পক্ষে বছরে বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ আয় করা সম্ভব। তাছাড়াও আগামী প্রজন্মের খাদ্য ও ওষুধের জোগান আসবে সমুদ্র থেকে। কাজেই সমুদ্রসম্পদকে দক্ষতার সঙ্গে আহরণ ও কাজে লাগাতে সমুদ্র বিষয়ে পরিকল্পনা, জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির দক্ষতা বিকাশের জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া এবং এ সম্পদ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য কার্যকর কর্মপন্থা নির্ধারণ আবশ্যক। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেলে আগামীতে হয়তো সুনীল অর্থনীতিই বাংলাদেশের অপর সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের মোট আমদানি পণ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ এবং রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ পরিবাহিত হয়ে থাকে। এই প্রাকৃতি পোতাশ্রয়টি কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গেপসাগরের সংযোগস্থল থেকে মাত্র ৯ নটিক্যাল মাইল অভ্যন্তরে অবস্থিত হওয়ার কারণে নদীপথের নব্যতা সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ এবং মালামাল উঠানাম করানো বেশ সুবিধাজনক বিধায় ব্রিটিশ ভারতের উত্তর–পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলীয় বিশাল অর্থনৈতিক পশ্চাদভূমির সহজতম সামুদ্রিক করিডোর হিসেবে চট্টগ্রাম ক্রমবর্ধমান ভূমিকা পালন করে আসছে। রাজনৈতিক বৈরিতায় ভারতের মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম ও সিকিম রাজ্য কিংবা নেপাল ও ভুটানের বৈদিশিক বাণিজ্যের ট্রাফিক চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের যে প্রতিবন্ধকতা ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সকল বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম করেছে এবং বন্দরের গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা তা বাস্তবরূপ লাভ করেছে।
দেশের প্রধান বন্দর নগরী, শিল্পনগরী, বাণিজ্যিক নগরী হওয়ার সুবাদে চট্টগ্রামে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম শিল্পাঞ্চল ‘বঙ্গবন্ধু শিল্প পার্ক।’
চট্টগ্রাম বিপ্লব তীর্থ হিসেবে ইতিহাসে নিজের অবস্থান গড়ে নিয়েছে। সকল স্বাধীনতা সংগ্রাম এ চট্টগ্রাম হতেই উচ্চারিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির ম্যাগনাকাটা বা মুক্তির সনদ এ চট্টগ্রাম হতেই ঘোষণা করেছিলেন। ফলে চট্টগ্রাম তার কর্মকাণ্ডে এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কর্ণফুলী নদীকে ও পর্বতমালা ঘেরা চট্টগ্রামের সৌন্দর্য্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখে অনেকের হিংসে হয়। ফলে চট্টগ্রামের কাংখিত উন্নয়ন এবং কর্ণফুলী নদী রক্ষার পরিকল্পনা বার বার বাধাগ্রস্থ হয়। ফলে কর্ণফুলীতে পলি জমে যায়। চট্টগ্রাম হয় সুবিধাবঞ্চিত।
বাংলাদেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু চট্টগ্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এবং জাতীয় নদী হিসেবে কর্ণফুলী নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কর্ণফুলী নদীর পাড়ে গড়ে উঠা চট্টগ্রাম নৌবন্দর প্রকৃতির অপার দান। আজ কর্ণফুলীতে নব্যতা ও চর দেখা দিয়েছে। নদীর পাড় দখল করে বসে আছে ভূমি দস্যুরা। কর্ণফুলী নদীর নাম ধারণ করে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রবঞ্চনার শিকার। আমাদের মনে রাখতে হবে কর্ণফুলী নদী শুধু একটি নদীর নয়। এটি বর্তমান দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নতির অপর নাম।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী