বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত শতাব্দীতে একটা বক্তব্যে বলেছিলেন যে, ‘আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ, এর নৌপথে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন আমাদের জন্য একটা বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে আসবে’। একইসাথে গত শতাব্দীর শেষ দশকে রাঙ্গুনিয়ায় একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক প্রতিষ্ঠার প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কটি মূলত আইটি ভিত্তিক। উদ্যোক্তারা চিন্তা করেছিলেন তাদের কাঁচামাল সমুদ্রপথে আমদানি করে কর্ণফুলীর মাধ্যমে রাঙ্গুনিয়া নিয়ে যাবে। অনুরূপভাবে পণ্য কর্ণফুলীর মাধ্যমে সমুদ্রের জাহাজে করে রপ্তানি করবে।
এই প্রেক্ষাপটে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ নাইন। দেশের অর্থনীতির প্রায় ৬৫ শতাশ এ মহাসড়কের ওপর নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক আকস্মিক বন্যায় আমরা এ মহাসড়কের গুরুত্ব মর্মে মর্মে অনুধাবন করেছি। মাত্র পাঁচ–সাত দিনের বন্ধে অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতাতেও এই মহাসড়ক অচল ছিল বেশ কিছুদিন। এমনটি হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। কলকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরেও অচলাবস্থা তৈরি হয়।
তদুপরি, গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়কের নিচে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করাতে হবে। এই মহাসড়ক নতুন করে আরও প্রশস্ত না করে যদি দ্বিতলবিশিষ্ট করা হয়, সে ক্ষেত্রে দু‘পাশের অনেক কৃষিজমি রক্ষা পাবে এবং বাধাহীনভাবে দূরপাল্লার গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সময়ও কম লাগবে। তখন বর্তমান রোড আঞ্চলিক এবং সার্ভিস রোড হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কোনো কারণে একটি বাধাগ্রস্ত হলে অন্যটি বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হবে। যে কোনো আপদকালে বিকল্প হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। এমনটি ভাবতে হবে জরুরি ভিত্তিতে।
বাণিজ্যে বৈষম্য দূরীকরণ :
বর্তমানে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন স্কেল থাকায় এবং ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করাতে না দেওয়ায় চট্টগ্রামের ব্যবসা–বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেখানে অন্যান্য অঞ্চলের শিল্পকারখানা ২০ টন, ৩০ টন এমনকি ৪০ টন পণ্য অবাধে পরিবহন করতে পারে, সেখানে চট্টগ্রামে ১৩ টানের বেশি পরিবহন করা যাবে না–এটা চট্টগ্রামের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ। যদি ওজন স্কেল চালু করতে হয়, তবে বাংলাদেশের সব জায়গায় একই সঙ্গে চালু করা হোক। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেখানে মহাসড়কের লোড ডিজাইন ৮০ থেকে ১০০ টন করা হয়, সেখানে আমাদের লাইফ লাইন কেন ১৩ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এটি নিয়েও ভাবতে হবে নতুন করে।
এছাড়াও নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীপথ ব্যবহার করে মহাসড়কের ওপর চাপ কমাতে পারি এবং পণ্য পরিবহনে ব্যাপক সাশ্রয় করতে পারি। আমরা জানি, চট্টগ্রাম থেকে ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, খুলনা, টেকেরহাট, নোয়াপাড়া, চাঁদপুর এসব নদীবন্দরের নদীপথের দূরত্ব সড়কপথের তুলনায় অনেক অনেক কম। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর করে এখান থেকে নদীপথে আমদানীকৃত ও উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী স্বল্প সময়ে এবং সাশ্রয়ী খরচে পরিবহন করা যায়। পাশাপাশি চট্টগ্রাম থেকে ভৈরব বন্দর, আশুগঞ্জ বন্দরসহ বিভিন্ন ঘাটে স্বল্প খরচে অল্প সময়ে পণ্য পরিবহন করা যায়। এতে গ্রাহক কম দামে পণ্য পাবেন এবং চট্টগ্রামের শিল্প উৎপাদনও বাড়বে। পাশাপাশি ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপরও গাড়ির চাপ কমে যাবে।
সবশেষে বলি, ঢাকা ও চট্টগ্রামে নদীপথ ছাড়া বিকল্প আরও সংযোগ মহাসড়ক করা দরকার। যেমন–মুহুরীগঞ্জ প্রজেক্ট থেকে সোনাপুর, নোয়াখালী রাস্তা দ্রুত শেষ করে চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া দরকার। ফেনী থেকে সেনবাগ কানকীরহাট হয়ে সোনাইমুড়ি–লাকসাম সড়ক সম্প্রসারণ করা এবং দ্রুত খুলে দেওয়া প্রয়োজন। বারইয়ারহাট করেরহাট হয়ে ফেনী চৌধুরী বাজার পর্যন্ত পুরোনো ঢাকা– চট্টগ্রাম মহাসড়কটি দ্রুত সংস্কার করে যে কোনো আপৎকালীনের জন্য প্রস্তুত রাখা যেতে পারে। মিরসরাই থেকে নারায়ণহাট পাহাড়ি রোড সংস্কার ও প্রশস্ত করা জরুরি। তা না হলে ভবিষ্যতে আবারও বিবিধ কারণে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ হয়ে জনজীবনে দুর্ভোগ হতে পারে এবং দেশের অর্থনীতিতে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
লেখক: অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জিপিএইচ ইস্পাত।