খাগড়াছড়ির প্রধান দুই নদী মাইনী ও চেঙ্গী। পাহাড় ও সমতলের সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসব নদী মিশেছে কাপ্তাই লেকে। প্রায় ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মাইনী নদী দীঘিনালা ও লংগদু উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মাইনীর তীরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য জনপদ, বাজার, গ্রাম, সবুজ প্রান্তর। এমনই এক গ্রাম ছবির মতো সুন্দর ইয়ারাংছড়ি। মাইনী নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠা গ্রামের আশপাশের বেশির ভাগ জমিই ছিল অনাবাদী। ভূমির গঠন বৈচিত্র্যের কারণে এখানকার অধিকাংশ জমি সারাবছর চাষ উপযোগী ছিল না। তবে এখন সেই চিত্র বদলেছে। মাইনী ও চেঙ্গী নদী খনন প্রকল্পের সুফল পাচ্ছে স্থানীয়রা। প্রথমবারের মতো পাহাড়ি নদী খননে এমন প্রকল্প নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এর ফলে নদী যেমন তার প্রাণ ফিরে পাচ্ছে, তেমনি নদী খননের মাটিতে অনাবাদী জমি ভরাট হওয়ায় তা চাষের উপযোগী হয়ে উঠেছে। সরেজমিনে ইয়ারাংছড়িসহ বেশ কিছু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অনাবাদী সব জমিতে রবিশস্যসহ অর্থকারী ফসলের চাষ হচ্ছে। দীর্ঘদিন পর অনাবাদী জমি চাষের আওতায় আসায় খুশি স্থানীয় কৃষক। অনাবাদী জমিতে নতুন ফসলের স্বপ্ন বুনছেন তারা।
স্থানীয় কৃষক মো. সুলতান ও মো. আবুল কাশেম খান বলেন, নদীটা সরু ছিল, আমরা খুব কষ্টে ছিলাম। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে চর জেগে উঠতো।নৌকা চলাচল করতে পারত না। খননের পর থেকে নদীতে পানি বেড়েছে, এখন মাছও পাওয়া যাচ্ছে। নৌকা চলাচল করতে পারছে। আমরা যারা কৃষক আছি তারাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছি। শত শত একর জমিতে নদী খননের মাটি ফেলায় জমিগুলো চাষ উপযোগী হয়েছে। অধিকাংশ জমিতে এবার চাষ হয়েছে। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর অনেক জমি প্রথমবাবের মতো এবার চাষের উপযোগী হয়েছে।
উত্তর ইয়ারাংছড়ি মসজিদ কমিটির সভাপতি মো. মজলিস খান বলেন, খনন হওয়ায় নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা বেড়েছে। আশপাশের যেসব জমি অনাবাদী ছিল সেগুলোতে এখন চাষ হচ্ছে। কিছু কিছু নিচু জমি ছিল সেসব জমিতে এক মৌসুম চাষ করলে তাড়াতাড়ি ফসল কেটে ফেলতে হতো। কারণ বন্যা হলে ফসল ডুবে যেত। এখন জমির উচ্চতা বেড়েছে, ফলে বন্যার পানিতে ফসল আর ডুববে না। জমি সারা বছরই চাষ করা যাবে।
উত্তর ইয়ারাংছড়ির বাজার সভাপতি মো. ফারুক হোসেন বলেন, মাইনী নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের এই বাজারে প্রত্যেক বছরই পানি উঠতো। এখন নদী খননের কাজ চলছে। সামনের মৌসুমেও পানি আর উঠবে না। বেশি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে পানি উঠলেও নদীর প্রশস্ততা ও গভীরতা বাড়ায় দ্রুত কমে যাবে। নদী খননের মাটিতে ফসলের জমির পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি নির্মিত হয়েছে নতুন সড়ক।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, খাগড়াছড়ি শহর ও তৎসংলগ্ন অবকাঠামো ভাঙন হতে সংরক্ষণের প্রকল্পের আওতায় নদীর গভীরতা বৃদ্ধি, মৎস আহরণ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে মাইনী নদী ও চেঙ্গী নদীতে খননের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে মাইনী নদীর প্রায় ২৩.০৬ কিমি এবং চেঙ্গী নদীতে ৩৪.৫৫ কিমি খনন কাজ করা হয়। ইতোমধ্যে পুরোদমে মাইনী নদীর ইয়ারাংছড়ি, ভাঙামুড়া ও মাইনীমুখ অংশ খনন কাজ চলছে। ২০২৫ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
তবে পাহাড়ি নদীতে খনন কাজ খুবই চ্যালেঞ্জিং বলে দাবি করেছে প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠন। খনন কাজে নিয়োজিত নবারুন ট্রেডার্সের প্রকৌশলী মো. মনির হোসেন বলেন, খনন করতে গিয়ে আমরা দেখছি নদীর মাটির নিচে প্রচুর গাছ পড়ে আছে। পাহাড়ি ঢলে এসব গাছ এসেছে। এছাড়া নদীর পাশে পাহাড় আছে, সেখানে প্রচুর পাথর হয়। এতে আমাদের কাজে ব্যাঘাত হয়। অনেক সময় ড্রেজিং মেশিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খনন কাজ শেষ করতে না পারলে সময় বাড়ানোর আবেদন করব।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ–বিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুর রহমান বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রথম মাইনী ও চেঙ্গী নদীতে খনন কাজ হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রায় ২৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাস্তবায়ন কাজ শেষ হলে নৌ চলাচল স্বাভাবিক হবে। স্থানীয় কৃষকও সুবিধা পাবে। এছাড়া নদীর বুকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার চর অপসারণ করা হবে। তিনি বলেন, চেঙ্গী ও মাইনী নদীতে বন্যার মূল কারণ পাহাড়ি ঢল। নদীর ধারণ ক্ষমতার তুলনায় পানি বেশি হলে এবং তা দ্রুত নেমে না গেলে বন্যা হয়। নদীতে ড্রেজিং হওয়ায় নদীতে পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়বে এবং ঢলের পানি দ্রুত কমে যাবে।