সিরিয়াল ভেঙে জাহাজ বরাদ্দসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) থেকে বের হয়ে গড়ে তোলা হয় নতুন সংগঠন আইভোয়াক। এখন এর কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। একটি মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাসের জন্য বরাদ্দ দেয়া সবগুলো জাহাজই একই কোম্পানির হওয়ায় সাধারণ জাহাজ মালিকেরা এই প্রশ্ন তুলেছেন। এই ধরনের কর্মকাণ্ডে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অবশ্য আইভোয়াকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশের বেশি পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়। এর মধ্যে ৫২ শতাংশ হ্যান্ডলিং হয় চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে, বাকি ৪৮ শতাংশ বহির্নোঙরে। বহির্নোঙরে বছরে ১০ কোটি টনের বেশি পণ্য খালাস করা হয়। বিকল্প এবং আধুনিক কোনো ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় বহির্নোঙরের পুরো পণ্য খালাস পরিচালিত হয় লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত গম, ভুট্টা, ডাল, চিনি, লবণ, বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, সার, সিমেন্ট ক্লিংকার, কয়লা, স্টোনসহ নানা পণ্য নিয়ে আসা বড় বড় মাদার ভ্যাসেলগুলো বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করে। এসব মাদার ভ্যাসেল বন্দরের জেটিতে প্রবেশ করতে পারে না। তাই তাদেরকে বহির্নোঙরে লাইটারেজ জাহাজের ওপর ভরসা করতে হয়। আবার চট্টগ্রাম বন্দরে বার্থিং নেয়া জাহাজের ওভার সাইড থেকেও লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস করে দেশের নানা অঞ্চলে সরবরাহ দেয়া হয়। বহির্নোঙর থেকে পণ্য নিয়ে লাইটারেজ জাহাজগুলো কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন ঘাট ছাড়াও দেশের অন্তত ৩৬টি নৌ বন্দরে পণ্য পরিবহন করে। প্রায় আঠারশ লাইটারেজ জাহাজ দেশব্যাপী পণ্য পরিবহনের এই নেটওয়ার্ক টিকিয়ে রেখেছে। অভ্যন্তরীণ নৌ রুটের এই ব্যবস্থাপনার ওপর দেশের বাজার ব্যবস্থা অনেকাংশে নির্ভরশীল।
গত কয়েক বছর ধরে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাতে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত লাইটারেজ জাহাজগুলো ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) এককভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করে আসছিল। লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের সমন্বয়ে এই সেল গঠন করা হয়। লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হওয়া এই সেলের বিরুদ্ধে সাধারণ জাহাজ মালিকদের অভিযোগ অনেক। যথাযথভাবে সিরিয়াল রক্ষা না করা, নেতাদের জাহাজকে বাড়তি সুবিধা দেয়া, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করাসহ নানা অভিযোগ। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ডব্লিউটিসিতে থাকা জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের একটি ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং বা আইভোয়াক বের হয়ে যায়। ডব্লিউটিসি ভেঙে আইভোয়াক এককভাবে নতুন সেল গঠন করে জাহাজ বরাদ্দ দেয়া এবং পণ্য পরিবহন শুরু করে।
এই সংগঠনের নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি সাধারণ জাহাজ মালিকদের চার শতাধিক জাহাজ নিয়ে আইভোয়াক যাত্রা শুরু করে। ডব্লিউটিসির অনিয়মের প্রতিবাদে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হলেও মাত্র দিনকয়েকের মধ্যে আইভোয়াকের বিরুদ্ধেও সিরিয়াল প্রথা না মেনে নেতাদের জাহাজকে বাড়তি সুবিধা দেয়ার অভিযোগ এসেছে।
আইভোয়াকের একাধিক সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ডব্লিউটিসির অনিয়মের প্রতিবাদে আমরা বেরিয়ে এসেছি। অথচ এখন এখানে আরো বেশি অনিয়মের কবলে পড়েছি। বিদেশ থেকে পণ্য নিয়ে আসা একটি মাদার ভ্যাসেলের পণ্য খালাসের জন্য প্রয়োজনীয় লাইটারেজ জাহাজের সবগুলোই একই মালিকের বরাদ্দ প্রদানের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। অনেক মালিকের জাহাজ যেখানে এক ট্রিপ ভাড়ার জন্য হাহাকার করছে, শ্রমিক–কর্মচারীদের বেতন যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে একই মালিকের এমভি ই এল মেটাডোর নামের একটি মাদার ভ্যাসেল বহির্নোঙরে পণ্য খালাস করে। এই জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের জন্য আইভোয়াক থেকে জাহাজ বরাদ্দ দেয়া হয়। সবগুলো জাহাজই একই মালিকের। বিএইচ সেলিম–২. মদিনা–৫, বিএইচ সেলিম–১, বিএইচ সেলিম–৭, বিএইচ সেলিম–১১, মদিনা–৭, ইরফান সেলিম, এইচ সেলিম–১, গুলশান আরা, বিএইচ সেলিম–১২ এবং এইচ সেলিম–৪ নামের উক্ত ১১টি লাইটারেজ জাহাজের মালিক ঢাকার জনৈক হাজী সেলিম। কর্ণফুলী নদীতে সাধারণ জাহাজ মালিকদের শত শত জাহাজ যেখানে অলস ভাসছে সেখানে শুধুমাত্র একজন মালিকের ১১টি জাহাজ একইসাথে বরাদ্দ পাওয়ার ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।
একাধিক জাহাজ মালিক বলেছেন, আমাদের জাহাজগুলো অলস ভাসছে। শ্রমিক–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা যোগাতে হিমশিম খাচ্ছি। পুরো মাসে একটিও ট্রিপ পায়নি এমন জাহাজের সংখ্যা অনেক। কিন্তু একজন মালিকের ১১টি জাহাজ একই মাদার ভ্যাসেলে একইসাথে ট্রিপ পাওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। এটি দুঃখজনক। তারা বলেন, অনিয়ম ঠেকানোর যে স্বপ্ন নিয়ে আইভোয়াকের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা ধুলিস্যাৎ হতে সময় লাগবে না।
এ বিষয়ে আইভোয়াকের মিডিয়া উইংসের প্রধান পারভেজ আহমেদ বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে কথা বলব এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।