২০২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটের স্নাতক (সম্মান) ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ কারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তীর্ণ বা পাস করেছে ৯.৬৯% শিক্ষার্থী আর ফেল করেছেন ৯০.৩১%। এই অনুষদের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলো উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকসহ তিন শাখার শিক্ষার্থীরা। শুধু এবার নয়, কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিক ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। যেমন ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত কলা অনুষদের অধীন খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি বিভাগে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছিলো মাত্র দুজন। অথচ তখন বিভাগটিতে আসন ছিল ১২৫টি। পরে অবশ্য অন্যভাবে সমস্যার সমাধান করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষার ভিত্তিতে শিক্ষার্থী বাছাই করা হয়। তবে পাস করলে সবাই ভর্তি হয়ে যাবে,এমনটা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে লাখ লাখ শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পাওয়ার পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কেন বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ন্যূনতম পাস নম্বর পান না? শুধু ভর্তি পরীক্ষায় নয়, ভর্তি হয়েও অনেকেই উচ্চশিক্ষায় পড়াকালে অসুবিধায় পড়েন। আবার কোনোমতে উচ্চশিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সময় অনেকে বড় রকমের ধাক্কা খান। একদিকে দক্ষতার অভাব অন্যদিকে চাকরির বাজারে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ না পাওয়ায় অনেকেই থাকে বেকার।
২০২১ সালে বিআইডিএসের করা এক জরিপের তথ্য বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা ৬৬% শিক্ষার্থী বেকার। অথচ দক্ষ জনবলের অভাবে ১১৫টি দেশের প্রায় ২০,৯৮৮ জন ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে এ দেশে বিভিন্ন খাতে কাজ করেন।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আসলে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাতেই রয়েছে বড় ধরনের গলদ। এই স্তরে দুর্বলতার কারণেই মূলত পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের এই করুন দশা। সরকারি বেসরকারি একাধিক গবেষণার তথ্য বলছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থী যতটুকু শেখার কথা, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তা শিখতে পারছে না। ফলে যতটুকু দক্ষতা অর্জন করার কথা, তা না করেই অনেক শিক্ষার্থী উপরের শ্রেণিতে উঠছে। এই ঘাটতি পূরণ না হওয়ায় শিক্ষার্থী প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরও পরবর্তী পর্যায়ে গিয়ে ধাক্কা খায়। যেমন প্রথম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ইংরেজি বাধ্যতামূলক। অথচ উচ্চমাধ্যমিক পাসের পরও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ইংরেজিতে ভাষাগত দক্ষতায় খুবই দুর্বল। এর সত্যতা পাওয়া যায়, বেসরকারি সংগঠন ওয়েব ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী ১,৫০০ এর বেশি শিশুর ওপর চালানো এক জরিপে। ১৪ জুন প্রকাশিত ওই জরিপের তথ্য বলছে, ১০% বেশি ছেলে এবং প্রায় ৯% মেয়ে বাংলায় বর্ণই পড়তে পারেনি। ইংরেজিতে বর্ণ পড়তে পারেনি ১৬.৭৮% ছেলে এবং ১৫.২২% মেয়ে। এ ছাড়া বাংলায় গল্প পড়তে পারেনি ৬২% ছেলে ও ৫৩% মেয়ে। ইংরেজিতে গল্প পড়তে পারেনি ৮৫% ছেলে ও ৮৩% মেয়ে। গণিতে একক অঙ্ক শনাক্ত করতে পারেনি ১৪.১৯% ছেলে এবং ১৩% মেয়ে। ভাগ করতে পারেনি ৯৬% ছেলে ও ৯৭% মেয়ে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে জরিপটি করা হয়।
এই জরিপের কিছুদিন আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এক গবেষণায় দেখা যায়, করোনার আগে ২০১৯ সালে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯%। এখন এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬%। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও আগের তুলনায় অবনতি হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সামপ্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৫০% শিক্ষার্থী জটিল বাক্য ও শব্দ পড়তে পারে না। এসব গবেষণার তথ্য বলছে, বড় ধরনের দক্ষতার ঘাটতি নিয়ে উপরের ক্লাসে উঠছে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা। মাধ্যমিকে গিয়েও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ইংরেজি ও গণিতে দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে থাকে।
অন্যদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অব সেকেন্ডারি স্টুডেন্ট (মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জাতীয় মূল্যায়ন) প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬১% শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে অবস্থা খারাপ। একই শ্রেণির গণিতে ৪৩% অবস্থা খারাপ। মাউশির মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ শাখা মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জাতীয় মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরির পর সবচেয়ে এগিয়ে থাকা এবং পিছিয়ে পড়া দেশের দুটি উপজেলার ফলাফল পর্যালোচনা ও সুপারিশমালা প্রস্তুতের লক্ষ্যে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়। ওই কর্মশালায় দুর্বলতা ও সাফল্যের কিছু কারণ উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাঁর প্রতিষ্ঠানের খারাপ ফলের জন্য কিছু কারণ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক খুবই কম। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠদানের জন্য প্রধান শিক্ষক ছাড়া মাত্র পাঁচজন শিক্ষক আছেন। বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের কোনো শিক্ষক নেই। অন্য বিষয়ের শিক্ষকেরা ‘প্রক্সি’ হিসেবে এসব ক্লাস নিয়ে থাকেন। অন্যদিকে সবচেয়ে ভালো উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, বেশির ভাগ শিক্ষক নিয়মিত বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এবং তাদের পড়ালেখায় উদ্বুদ্ধ করেন। বিদ্যালয়ে প্রতিটি শ্রেণির সব শিক্ষার্থীর অভিভাবকের মুঠোফোন নম্বর রয়েছে। ফলে কোনো শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকতে পারে না। শিক্ষা কর্মকর্তারা বিদ্যালয়ে নিয়মিত পরিদর্শনে আসেন। বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়মুখী, অভিভাবকেরাও সচেতন।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রধান ও সহকারী শিক্ষক মিলিয়ে ৩৭,৯২৬টি শিক্ষকের পদ শূন্য আছে। এ ছাড়া বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষাপঞ্জিতে উল্লেখিত ছুটির বাইরেও নানা উপলক্ষ্যে লম্বা ছুটি থাকে। যেমন চলতি বছরের শিক্ষাপঞ্জিতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক ছুটি ৭৬ দিন। এই ছুটির বাইরেও এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র থাকায় আরো এক মাসের বেশি সময় অনেক বিদ্যালয়ে ছুটি ছিলো। এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠিক মতো শ্রেণি কার্যক্রম না থাকলে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক ভাবেই পড়ালেখা থেকে দূরে থাকে। এতে তারা পিছিয়ে পড়ে। এমন প্রক্রিয়ায় বিদ্যালয়ের পাশাপাশি কোচিং প্রাইভেট মিলিয়ে পরীক্ষার বৈতরণী পার হলেও একেকটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের যে দক্ষতা অর্জন করার কথা, তা ঠিক মতো অর্জিত হয় না। আর এর প্রভাব পড়ে উচ্চশিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে।
অবশ্য মাউশির ওই প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দেশের অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ এবং বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিশ্চিত করা।
মাউশির মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর জাতীয় মূল্যায়ন শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব শিক্ষার্থী পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অন্যান্য বই পড়ে, তাদের ফলাফল ভালো। সুতরাং শ্রেণি কার্যক্রম চলাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার খোলা রাখা ও ভাষাগত সমস্যা দূর করার জন্য এনসিটিবির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। ওয়েব ফাউন্ডেশনের গবেষণা প্রতিবেদনে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানো, শ্রেণির পড়া শ্রেণিতেই শেষ করা, শিক্ষকদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাসহ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত চলতি বছর চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম ঠিক মতো বাস্তবায়ন করা গেলে শিক্ষার্থীদের শেখানোর ক্ষেত্রে নতুন শিক্ষাক্রম ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে তারা মনে করেন। লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।