দৈনিক আজাদীতে গত ২৯ জানুয়ারি ‘১০০ দিনের অগ্রাধিকার কর্মসূচিকে প্রাধান্য’ ও ‘ সবার সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করব’ শীর্ষক দুটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে প্রথম পাতায় শীর্ষ প্রতিবেদন হিসেবে। দুটি সংবাদই নবনির্বাচিত মেয়র মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরীকে নিয়ে। মেয়রের ১শ’ দিনের অগ্রাধিকার কর্মপরিকল্পনায় প্রথমে মশার উপদ্রব রোধ করার কথা জানিয়েছেন। এছাড়াও কর্মপরিকল্পনায় রয়েছে জরুরি ভিত্তিতে নগরীর রাস্তাঘাট সংস্কার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, যানজট নিরসন। তিনি বলেন, মশার যন্ত্রণায় সকলেই অস্থির। আমাকে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে মশার উৎপাতের কথা বলা হয়েছে। আমি দায়িত্ব গ্রহণ করে জরুরি ভিত্তিতে মশার উৎপাত থেকে নগরবাসীকে মুক্ত করার চেষ্টা করবো। এছাড়াও নগরবাসীর আরেক যন্ত্রণার নাম যানজট। যানজটের কবলে পড়ে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন। যানজট থেকে নগরবাসী মুক্তি চান। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর যানজট নিরসনকে গুরুত্ব দেবো।
অপর অনুষ্ঠানে রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, এই চট্টগ্রামকে আমি পরিকল্পিতভাবে সাজাতে চাই। এজন্য সবার সঙ্গে পরামর্শ করে এবং তা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পর্যালোচনা করে যেটা বাস্তবসম্মত হবে সেটাই গ্রহণ করব। তাহলে ভুল কম হবে। ৪১ ওয়ার্ডে স্বাস্থ্য সেবাকে জনগণের দোড় গোড়ায় নিয়ে যাব। মেয়র পদে তাকে ভোট দিয়ে জয়ী করায় নগরবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছি। তা বিবেচনায় নিয়ে জননেত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। এই বিজয় আমার নয়, এই বিজয় চট্টগ্রামবাসীর। এই বিজয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতীক নৌকার। মানুষ আমাকে এত পছন্দ করেছে আমি অভিভূত। মানুষ ভালোবেসেছে, মর্যাদা-সম্মান দিয়েছে। কথা দিতে পারি, সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
জলাবদ্ধতা নিরসন ও চিকিৎসা সেবার সংকট নিয়ে কাজ করার আগ্রহের কথা জানিয়ে রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ছয় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমবে। খালগুলো দখল হয়ে গেছে, উদ্ধার করতে হবে। আমি নিজেও জলাবদ্ধতার শিকার। চেষ্টা করবো আগামী ৫ বছরের মধ্যে জলাবদ্ধাতা নিরসন করতে। যানজটের সদস্যা আছে সেটাকে নিসরণ করবো। সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবকে চট্টগ্রামের বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সমন্বয়ের অভাবে সুন্দর রাস্তা করার দুমাসও ঠিক থাকে না। সিটি কর্পোরেশন রাস্তা করলে, দুই মাসের মধ্যে ওয়াসা কেটে ফেলে, টিএন্ডটি কেটে ফেলে, পিডিবি কেটে ফেলে। উন্নয়নের জন্য কাটতে হবে- কিন্তু সরকারি টাকার অপচয় হবে কেন? আগে মেয়ররা উদ্যোগ নিলেও সেবা সংস্থাগুলো যে প্রতিনিধি পাঠায় এতে ফাঁক থেকে যায়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব, যেন দুর্ভোগ থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে পারি। সমন্বয় সভায় সবাই যেন উপস্থিত থাকেন সেই চেষ্টা করব। সমন্বয়ের অভাবে নগরবাসী যেন কষ্ট না পায়। সেই চেষ্টা করব।
আসলে মেয়রকে হতে হবে জনগণের সেবক। যিনি গরীব, দুঃখী মানুষের সুখে রাখবেন, সব সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। নগরীর ভেতরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স, হোল্ডিং ট্যাঙ সহনীয় পর্যায়ে আনা, ব্যবসায়ীদের উপর জুলুম না করা, সর্বদা ব্যবসায়ীদের কল্যাণে কাজ করে সমৃদ্ধিশালী নগর গড়ে তুলতে দক্ষ হিসেবে মেয়রের বিকল্প নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, চট্টগ্রামের উন্নয়ন হচ্ছে না, তা বলা যায় না। তবে এসব উন্নয়ন কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই হচ্ছে, তা সেখানে গিয়ে চারিদিকে চোখ মেললেই বোঝা যায়। এ কারণে এই বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত শহরটি দিন দিন একটি ভারসাম্যহীন কষ্টের নগরীতে রূপ নিচ্ছে। ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে, তেমন চট্টগ্রামও বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। কোনও চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই পাহাড়-টিলা কেটে অথবা খুঁড়ে ভবন ও বস্তির সারি, খাল-ছড়া ও নালার ওপর মার্কেট ও ঘরবাড়ি, পুকুর-দীঘি ভরাট করে এই নগরীর শোভা হারিয়ে গেছে। চট্টগ্রামে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। সে তুলনায় আবাসন বাড়ছে না। যা হচ্ছে তার বেশিরভাগই অপরিকল্পিত। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে জনসংখ্যা। বছরে যোগ হচ্ছে অন্তত ৫০ হাজার নতুন মানুষ। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, সড়ক, পার্ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, পানি ও বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা, গণপরিবহনসহ নাগরিক সুবিধাগুলো কমে গেছে।
চট্টগ্রামের উন্নয়নের কথা ভাবতে-ভাবতেই প্রায় পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। এই সেই চট্টগ্রাম যেখান থেকে আমাদের ৪০ ভাগ শিল্প উৎপাদন আসে, ৮০ ভাগ অভ্যন্তরীণ ব্যবসা হয় এবং ৫০ ভাগ সরকারি আয় আসে। চট্টগ্রামের পুঁজিবাজারে সাতশ’র বেশি কোম্পানি প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে। একটা সময় ছিল যখন দেশি ও বিদেশি সবচেয়ে পুরনো কোম্পানিগুলোর সদরদফতর চট্টগ্রামে ছিল। ইউনিলিভার ও রেকিটের মতো কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা চালাত চট্টগ্রাম থেকে। তারা চট্টগ্রাম ছেড়েছে যখন ব্যবসার সুযোগ-সুবিধা সেখানে কমে গেছে। এখনও দেশের প্রায় সব ইস্পাত কারখানাগুলো রয়েছে চট্টগ্রামেই।
ট্রাফিক ব্যবস্থা এবং গণপরিবহনের কথা বলা হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই প্রায় পুরো চট্টগ্রাম শহর হাঁটু-পানিতে তলিয়ে যায় এবং জনজীবন অচল হয়ে পড়ে। অনেকে অনেক কিছু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু চট্টগ্রামবাসী সেই হাঁটুজলেই রয়ে গেছেন। এসব কিছু এখন নতুন মেয়রের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।