নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা; অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর

অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন | শুক্রবার , ৮ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

২০২৪ সালের জুলাইআগস্ট মাস বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা কোটি মানুষের আশাআকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের সাক্ষী হয়ে থাকবে চিরকাল। কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া একটি আপাত সাধারণ আন্দোলন ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এক অসাধারণ গণজাগরণ রূপে, যেখানে দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনটিকে ঘিরে ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল রাজনৈতিক দল, মতবাদ ও সাধারণ জনগণের ঐক্য গড়ে ওঠে, যা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তিকে একত্রিত করে। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে গড়ে ওঠা প্রাচীন শৃঙ্খল ভাঙার এই দুঃসাহসিক যাত্রায় নানা বাধা আসলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই গণজাগরণ থেমে থাকেনি। অবশেষে ৫ আগস্টের বিভীষিকাময় রাতে নতুন ভোরের আলো আসে; ৮৪ বছর বয়সী নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা আসে, যা দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের নতুন অধ্যায় সূচনা করে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রাপথ ছিল এক সুদূরপ্রসারী স্বপ্নের প্রথম ধাপ। এই স্বপ্নের কেন্দ্রে ছিল এমন এক বাংলাদেশের রূপকল্প, যেখানে মানুষের ভোটাধিকার সুরক্ষিত থাকে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গুমখুনরাহাজানির অবসান ঘটে। এটি শুধুমাত্র সরকার পরিবর্তন ছিল না; বরং এটি রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোয় দীর্ঘদিন জমে থাকা জঞ্জাল পরিষ্কার করার একটি মহৎ উদ্যোগ। গত এক বছরে এই সরকার যে কাজগুলো করেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তবে এই সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হবে। এটি কোনো একক গোষ্ঠীর সরকার নয়, বরং জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিফলন। একটি স্বতঃস্ফূর্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে এই সরকারের সফলতা পূর্ণতা পাবে।

প্রথমত, ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার ব্যাপক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে যাতে তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে পারে। নির্বাচনের জন্য কমিশন ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু করেছে এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে কাজ করছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা দেশের নির্বাচনী অংশগ্রহণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। নির্বাচনী আইন ও বিধিমালা সংস্কার করা হচ্ছে, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পোস্টাল ব্যালট ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় বাজেটে নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রায় ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়েছে এবং নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, যা নির্বাচনী পরিবেশকে আরও স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ করতে সহায়তা করবে।

দ্বিতীয়ত, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং রাজনৈতিক দমনযন্ত্রের সংস্কৃতি দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। ২০১৫২০২১ সালের মধ্যে প্রায় দুই হাজারের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনা ঘটে, যার অধিকাংশই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনকেন্দ্রিক ছিল। বর্তমান সরকার এসব ঘটনার তদন্তের জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এবং দোষীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। পুলিশ বাহিনী সংস্কারে মনোযোগ দিয়ে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে মানবাধিকার রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। জাতিসংঘও বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে স্বাধীন তদন্ত সংস্থার প্রয়োজনীয়তার সুপারিশ করেছে। এসব পদক্ষেপ রাষ্ট্রযন্ত্রকে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়নে একটি মাইলফলক।

তৃতীয়ত, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সচেষ্ট। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হলেও এর মূল বার্তা ছিল সমতাভিত্তিক ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠন। শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং সরকারি চাকরিতে মেধা ও যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বৈষম্যমূলক নীতি পরিবর্তন আনা হয়েছে। উচ্চশিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে প্রবেশিকা পরীক্ষা পুনর্গঠন করা হয়েছে, যা যোগ্য শিক্ষার্থীদের সুযোগ বৃদ্ধি করেছে। সরকারি চাকরিতে দক্ষতা ভিত্তিক নিয়োগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, যা বৈষম্য কমিয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে। এসব পদক্ষেপ দেশের সামাজিক সাম্যের উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

চতুর্থত, জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। অতীতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করার জন্য যেসব আইন ও প্রক্রিয়া প্রয়োগ হতো, তা অনেকটাই শিথিল করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন সংশোধন এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মত প্রকাশের সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের অবাধ, নিরাপদ ও উন্মুক্ত মত প্রকাশের পরিবেশ তৈরির জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষণ ও আইনগত সুরক্ষা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মত প্রকাশের স্বাধীনতার সূচকে সামান্য উন্নতি দেখা গেছে, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য।

পঞ্চমত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে প্রায় ৫০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করে ঋণপরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, যা আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিংয়ে সহায়ক হয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিটেন্স প্রবাহ ১৫% বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে ভর্তুকি ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা প্রয়োগে মুদ্রাস্ফীতি ৫.% এ নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সাপ্লাই চেইন উন্নয়নে নেওয়া পদক্ষেপে বাজারে জিনিসপত্রের সুষ্ঠু সরবরাহ নিশ্চিত হয়েছে, যা মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করছে। এছাড়াও প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশীয় ঐক্যের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার মাধ্যমে ভারতের কবল থেকে দেশের মুক্তির প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সর্বোপরি, সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সরকার জোর দিয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষণ ও সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে, যা ন্যায়বিচারের গুণগত মান উন্নয়নে সহায়ক। জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা দেশ পরিচালনায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক গোষ্ঠীকে একত্রিত করে একটি শক্তিশালী জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সরকারের অগ্রাধিকার হিসেবে কাজ করছে, যা দেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

এক বছরে সরকারের এসব অর্জন ও উদ্যোগ দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তবে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। এই বাধাগুলো মোকাবিলা করে সংস্কারের ধারাকে অব্যাহত রাখা সরকার ও জনগণের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। জনগণের প্রত্যাশা অনেক এবং তা পূরণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য।

অতএব, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর শুধু সময়ের হিসাব নয়, বরং নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রার সূচনা। এটি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যেখানে দীর্ঘদিনের অবহেলা ও বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বীজ বপন করা হয়েছে। এই সরকারের সফলতার জন্য জনগণের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা অপরিহার্য। আশা করা যায়, এটি শুধু স্বপ্নের কথা নয়, বরং স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হয়ে থাকবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ এবং উপউপাচার্য (প্রশাসন), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক বছরে জনবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণের ফলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে
পরবর্তী নিবন্ধএক বছরের মধ্যে অক্সিজেনে ভেঙে যাওয়া ব্রিজ নির্মাণের ঘোষণা মেয়রের