কলেজ থেকে ফেরার পথে আড়ং যাওয়ার উদ্দেশ্যে দুই নাম্বার গেইট হয়ে দীর্ঘ জ্যামে আটকা পড়েছি। হঠাৎ চোখে পড়ে আট–দশটি চৌদ্দ/ পনেরো এবং দু–চারটে পাঁচ–ছয় বছরের ছেলে ফুটপাতে বসে পলিব্যাগের কী যেন নাকে নিচ্ছে। ঠিক ঠাক বুঝতে না পেরে ড্রাইভারকে জিগ্যেস করলে, একটু ইতস্তত হয়ে উত্তর দিল তারা এসব গাম খাচ্ছে। বিষয়টি তারপরও মাথায় না আসলে যেটা সে বোঝালো তা হলো, এটা এক ধরনের গাম যা নাকে নিলে নেশা হয়। বিষয়টি একটু কষ্টের অনুভব হলে কয়েকটি ছবি নিতে চাইলাম। অমনি চৌদ্দ–পনেরো বছরের দুটি ছেলে গাড়ির জানালা ধরে জিজ্ঞেস করছিলো ছবি নিচ্ছি কেন? কিন্তু ছেলেগুলোর চোখের স্থির, হিংস্র চাহনি ঠিক এমন ছিলো যে অনেকটা আঁতকে উঠে তড়িঘড়ি করে জানালার কাচ তুলে দেই। তাদের চোখের তারায় কোথাও মায়া–মমতা বা শিশুসুলভ কোনো কথাই ছিলো না। মনে হতে থাকলো এদের দ্বারা যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানো নয় শুধু মানুষও অনায়াসে খুন করে ফেলা কোনো বিষয় না। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।
আর প্রতিটি দিন পত্রিকার পাতা ওল্টাতেই চোখে পড়ে, কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে বাসায় ফেরার পথে স্কুলছাত্রকে কুপিয়ে জখম, টঙ্গীতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় পোশাক শ্রমিক আহত এবং সড়ক অবরোধ, কুমিল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে কলেজছাত্র নিহত, কলেজছাত্র সিয়াম হত্যা, ৮ মাদ্রাসাছাত্র গ্রেপ্তার, কুমিল্লার তিতাসে ‘কিশোর গ্যাং সদস্য’দের ছুরিকাঘাতে সিয়াম সরকার নামে এক যুবক খুন হয়েছে, নিষিদ্ধ দলের মদদে বেপরোয়া কিশোর গ্যাং, মিরপুর থেকে ‘অপুর দল’–এর ৩ সদস্য গ্রেপ্তার – এমন সব শিরোনামে ভয়ঙ্কর সব নানা খবর।
আমি নিজেও একজন কলেজ শিক্ষক। দীর্ঘ দিনের শিক্ষকতা পেশায় থেকে অনায়াসে বলা যায়, কলেজে ৯৫% শিক্ষার্থী পড়াশোনায় যথেষ্ট মনোযোগী হলেও ৫% শিক্ষার্থী আছে যারা পড়াশোনায় অমনোযোগী যতো খানি ঠিক ততোটাই তাদের আচার আচরণ, পোশাক আশাক, কথাবার্তা, চালচলন, গতিবিধি যা একেবারেই ছাত্র সুলভ নয়। এ ছাড়া আধিপত্য বিস্তারের জন্য তারা অস্ত্র যেমন– ছুরি, রামদা, হকিস্টিক, বন্দুক ইত্যাদি সংগ্রহে রাখে। তাদের বুক চেতানো অঙ্গ ভঙ্গি বলে দেয় যেন তারা শুধু শিক্ষক কেন যেকোনো কারো উর্ধ্বে থাকা ভিন্ন কোনো প্রজাতির মানুষ; যাদের মাথার ওপর অলৌকিক কোনো ছায়া আছে। যার কারণে তারা ভূপৃষ্ঠে থাকা মানুষগুলোকে মানুষ বলে দৃষ্টিগোচর করতে নারাজ। আর এই ৫% শিক্ষার্থীদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে বাকী ৯৫% শিক্ষার্থী শুধু নয়, শিক্ষকও অনেক ক্ষেত্রে আতঙ্কে থাকেন কখন কী ঘটনা ঘটে যায়! সকলেই নিজস্ব কায়দায় নিজেদের আড়াল করে বাঁচিয়ে চলে।
পুত্র সন্তান আমার নিজের পেটেও ধরেছে। একই সাথে এ বছরই ও লেভেল পরীক্ষা দেবে। ধরতে গেলে ওপরে বর্ণিত কিশোরদের বয়সী। সন্তান স্কুলে যায়, শিক্ষকের কাছে পড়তে গিয়ে দিনের অর্ধেকেরও বেশি সময় পার করে। আতঙ্কিত হয় মায়ের হৃদয় ছেলেটা আমার বাইরে গেলো ঠিকঠাক বাসায় পৌঁছাবে তো? কোনো এমন ছেলেদের পাল্লায় পড়ে নেশাগ্রস্ত হবে নাতো? কোনো নানা রঙচঙে নামধারী কিশোর গ্যাং এর সাথে জড়িয়ে আমার অবুঝ সন্তানের হাতে এমন কোনো ঘটনা ঘটবে নাতো যাতে শুধু আমরা পিতামাতা কেন সমগ্র জাতি কলঙ্কিত হয়! কখনো নিজে সঙ্গে যাই, কখনো বাসায় আসলে গায়ের গন্ধ শুঁকে দেখি, বিছানা বা তার ব্যাগ কিংবা রুমের সকল জায়গা ঘেটে দেখি কোনো সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় কিনা। যদিও ছেলে এতে চরম বিরক্ত হয়। তাকে বুঝিয়ে বলি। মায়ের মন তো! ভয়–আতঙ্কে মনটা ছোট হয়ে থাকে।
কিশোর অপরাধ আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে। তবে দিন যত যাচ্ছে তাদের অপরাধগুলো ক্রমেই হিংস্র, নৃশংস ও বিভীষিকাপূর্ণ রূপে দেখা দিচ্ছে। সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার মতো হিংস্র ও ঘৃণিত অপরাধ করার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে এবং বেড়েই চলেছে।
মূলত ২০১৭ সালে ঢাকার উত্তরায় আদনান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের সহিংসতার নির্মমতা জনসম্মুখে আসে। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্যমতে, কেন্দ্রে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে ৮২১টি মামলায় গ্রেফতারের সংখ্যা ১ হাজার ১৯১।
যদি বন্দর নগরীর দিকে চোখ রাখি, র্যাব–৭ এর অধিনায়ক লে. কর্ণেল মো. মাহবুব আলম বলেন, বন্দর নগরী চট্টগ্রামে ১৬ থানা জুড়ে ৫০টির বেশি কিশোর গ্যাং গ্রুপে অন্তত ৩ হাজার কিশোর সক্রিয়। যাঁরা মূলত আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং এমনকি হত্যার মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। এরা ইয়াবা–ফেনসিডিলসহ নানা মাদকদ্রব্য সেবন করছে। আধিপত্য বিস্তারে ব্যবহার করছে অবৈধ অস্ত্র।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে বয়সে আমাদের সন্তানদের পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার কথা, সে বয়সে ছেলে–মেয়েদের এমন অপরাধে জড়ানোর কারণ কী হতে পারে? বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, সন্তানকে যথেষ্ট সময় না দেওয়া, সামাজিক অবক্ষয়, স্বল্প বয়সে স্মার্টফোনসহ উন্নত প্রযুক্তি উপকরণের নাগাল পাওয়া, সঙ্গদোষ, যৌক্তিকতা বিচার না করেই সব আবদার পূরণ করা এবং সন্তান কী করছে সে বিষয় পর্যবেক্ষণের অভাব ইত্যাদি নানাবিধ কারণে কিশোরদের অপরাধে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
এখন শুধু বাড়ার প্রবণতার কথা বললেই চলবে না। বরং এটি নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেয়ার সময় এসেছে। শিশুর সামাজিক জীবনের ভিত্তি, তার প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারেই রচিত হয়। তাই তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের উত্তম স্থান হলো এই পরিবার। পরিবার ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ইতিবাচক পদক্ষেপ ও স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর উদ্যোগ ছাড়া গ্যাং কালচার রোধ করা সম্ভব নয়। কিশোর অপরাধ দমনে শুধু আইন প্রয়োগই নয়, সামাজিক সচেতনতা জরুরি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে কিশোরদের মধ্যে বখাটেপনা এবং নিত্য–নতুন অপরাধপ্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ক্রমেই। এসব থেকে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য ছাত্রদের ক্লাসে মনোযোগী করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ভাবতে হবে, শিশুদের প্রতিভা ও মেধা বিকাশে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন স্কাউটিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ক অলিম্পিয়াড, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইত্যাদি আয়োজন করা যেতে পারে নিয়মিত।
রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা থেকে আমাদের অনেকের মাঝে বিরাজ করছে হতাশা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা, সেই হতাশা থেকেই ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক ভিত্তি পোক্ত করতে অনেক সময়ই রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় লোকেরা কিশোরদের ব্যবহার করছে একই সাথে তাদের বিভিন্ন অনৈতিক কাজে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে তাদের অসামাজিক কার্যকলাপকে উস্কে দিচ্ছে। এজন্য রাজনৈতিক নেতাদেরও একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছাতে হবে যাতে আগামী প্রজন্ম এভাবে তাদের হাতেই ধ্বংস হয়ে না যায়। কারণ নষ্ট প্রজন্ম নিয়ে নেতৃত্বে বেশি দূর এগুনো কখনো ফলপ্রসূ হতে পারে না।
আরেকটি বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে, তা হচ্ছে কিশোর সংশোধন কেন্দ্র। প্রচলিত আইনে ১৮ বছরের নিচে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় তাদের বড় কোনো শাস্তির পরিবর্তে পাঠানো হচ্ছে কিশোর সংশোধনাগারে। কিন্তু পাঠানো হলেও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে সংশোধনাগার থেকে বেরিয়ে এসে যদি আবার অপরাধে জড়িয়েই পড়ে। এজন্য প্রয়োজন আইন সংস্কার এবং কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা।
এসবের পাশাপাশি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রচারের সময় ভিলেন হিসেবেই উপস্থাপন করা যাতে কেউ উৎসাহিত না হয় এজন্য একটি বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।
আমাদের প্রজন্মই আমাদের ধারক বাহক। পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষায় এখনই এর লাগাম টেনে ধরতে সচেষ্ট হতে হবে পরিবার সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের। এরা কার সন্তান এটা দেখার বিষয় না। মনে রাখা প্রয়োজন এরা সবাই আমাদেরই সন্তান। তাদের সঠিক পথ দেখানো আমাদের সকলের নৈতিক ও পরম দায়িত্ব। উন্নত ও স্বাস্থ্যবান প্রজন্ম গঠন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সামাজিক–মানবিক মানুষ হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধতা।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও কলেজ শিক্ষক।