সর্বসাধারণের একটি অভিযোগ ছিল, বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীসেবার মান কমতে কমতে সর্বনিম্নে নেমেছিল কয়েক বছর আগে। এরপর একের পর এক নতুন ট্রেন চালু, পুরাতন রেকের বদলে নতুন রেক পুনঃস্থাপন, অনলাইনে টিকিট বিক্রি, টিকিট ছাড়া স্টেশনে প্রবেশ করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে রেলের সেবায় নতুন গতি সঞ্চারিত হয়েছে। ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করেছে যাত্রীসেবার মান, বাড়ছে সুযোগ সুবিধা। যাত্রা হচ্ছে নির্ঝঞ্ঝাট ও বাধাহীন।
গত ২০ আগস্ট দৈনিক আজাদীতে ‘তিন রুটে তিনটি নতুন ট্রেন চালুর পরিকল্পনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা যায়, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তিন রুটে আরো তিনটি নতুন ট্রেন চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। ঢাকা–চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম–চাঁদপুর এবং চট্টগ্রাম–সিলেট রুটে নতুন তিনটি ট্রেন চালুর ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল থেকে রেল মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এই প্রস্তাবে রেলমন্ত্রী, সচিব এবং ডিজির সম্মতি আছে বলে জানা গেছে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আমদানি করা আধুনিক উচ্চগতির কোচ দিয়ে এই তিন রুটে নতুন ট্রেন চালানো হবে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এখন নতুন ট্রেন চালুর ব্যাপারে কোচ ও ইঞ্জিন সংকট নেই বলে জানান পূর্বাঞ্চলের পরিবহন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। ঢাকা–চট্টগ্রাম রেলপথে বর্তমানে যেসব ট্রেন রয়েছে, তাতে যাত্রীদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। এদের বাধ্য হয়ে বেশি ভাড়ায় ভোগান্তি ও ঝুঁকি নিয়ে সড়কপথে যাতায়াত করতে হয়। তাই নতুন ট্রেন চালুর দাবি অনেকদিনের।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম–ঢাকা রুটে এখন ৬ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে মহানগর এঙপ্রেস ১৯৮৫ সালে, মহানগর গোধূলী ১৯৮৬ সালে, সুবর্ণ এক্সপ্রেস ১৯৯৮ সালে, তূর্ণা এক্সপ্রেস ২০০০ সালে এবং ২০১০ সালে চট্টলা এক্সপ্রেস চলাচল শুরু হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে এই রুটে যুক্ত হয় বিরতিহীন আন্তঃনগর সোনার বাংলা।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, জানা যায়, গত দুই অর্থবছরে শুধু রেল পরিচালনায় লোকসান গুনতে হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অভিযোগ রয়েছে, পূর্বাঞ্চল রেলপথে চলাচলকারী ট্রেনগুলোতে অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাত্রীদের। বিলম্বে চলাচল যেন এসব ট্রেনের নিয়ম। ভিড়ের কারণে স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়। হকার, হিজড়াদের উৎপাতেও অতিষ্ঠ যাত্রীরা। টয়লেট, ফ্যান ও আলোর স্বল্পতায় মেইল ট্রেনগুলোতে চলা বড় দায়। এছাড়া, বাস মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা গাফিলতি করে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাড়ে লোকসানের বোঝা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, উন্নত প্রযুক্তি ও অবকাঠামো, দ্রুতগতির ট্রেন, সময়মতো চলাচল নিশ্চিত করার পাশাপাশি যাত্রীসেবার মান উন্নত করে বহু দেশ তাদের রেল যোগাযোগব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হলেও আমাদের দেশে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। রেলওয়ের উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও কোচের ওপর নির্ভরতা কমানোর পদক্ষেপও দৃশ্যমান নয়। বস্তুত সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও অব্যবস্থাপনার বিষয়টি বহুদিন ধরে আলোচনায় থাকলেও এসব খাতে অগ্রগতিও দৃশ্যমান নয়। যেসব দেশের রেলওয়ে স্বাবলম্বী, সেসব দেশে সেবার মান বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ খাতে গুরুত্ব না বাড়িয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ রেলওয়ে কতটা লাভের মুখ দেখবে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। যেহেতু দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে রেলের রুগ্ণ দশা কাটছে না, সেহেতু এ সংস্থার সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষকে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। রেলপথকে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্যও নিতে হবে পদক্ষেপ।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন হিসেবে রেলপথ সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে জনপ্রিয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও গড়ে উঠেছে আধুনিক রেল যোগাযোগব্যবস্থা। নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমণের মাধ্যম হিসেবে রেল সবখানেই যাত্রীদের প্রথম পছন্দ। শুধু বাংলাদেশে রেলওয়েকে সব সময় চরম অবজ্ঞা করা হয়েছে। এখানে অনিয়ম–অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি যাত্রীসেবার মান তলানিতে এসে ঠেকেছে। বলা যায়, রেলের উন্নয়নের পেছনে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করা সত্ত্বেও দেশে ট্রেনের গতি যেমন বাড়েনি, তেমনি বাড়েনি যাত্রীসেবার মান। ফলে রেলের উন্নয়ন পরিকল্পনার মান নিয়ে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন তোলা যায়। সড়কের চেয়ে রেলে দুর্ঘটনা কম হওয়ায় সাধারণ মানুষ একসময় রেল ভ্রমণেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বেশি। সেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধের প্রতি মর্যাদা প্রদান জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুন ট্রেন চালুর পরিকল্পনার পাশাপাশি সেবার মানও বাড়াতে হবে।