কয়েক সপ্তাহ আগেও বিবিসিকে দেখে মনে হচ্ছিল, তারা মৌসুমী ঝড়ের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে। বাজেট কাটছাটের উদ্যোগ থেকে সরকারের পিছু হটা এবং করোনাভাইরাস মোকাবেলা নিয়ে বিস্তৃত কাভারেজের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রায়ত্ত সমপ্রচার মাধ্যমটি নিজের অবস্থান মজবুত করেছে বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু না শেষ রক্ষা হয়নি, সিকি শতাব্দী আগে রাজ পরিবারের সদস্য প্রিন্সেস ডায়ানার একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে ‘প্রতারণার’ ঘটনা ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন-বিবিসিকে নতুন ঝড়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
এই ঝড় কেন এল, বিবিসি কীভাবে তা মোকাবিলা করতে পারে এক বিশ্লেষণী মন্তব্য প্রতিবেদনে তা তুলে ধরেছেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের মার্ক ল্যান্ডলার। তিনি বলেন, চলতি সপ্তাহে স্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিবিসিকে তোলপাড় করা ঝড়টি আঘাত হানে। ১৯৯৫ সালে প্রিন্সেস ডায়ানার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বিবিসির সাংবাদিক মার্টিন বশির অনৈতিক উপায় অবলম্বন করেন এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আড়াই দশক ধরে এই ছল-চাতুরির বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখেন বলে ধরা পড়ে।
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জনসন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা নতুন সংস্কারের সতর্কবার্তা দিয়েছেন, ডায়ানার ছেলেরা তার মায়ের মৃত্যুর জন্য পরোক্ষ দায় চাপিয়েছে এই সমপ্রচার মাধ্যমের ওপর এবং বিবিসির নির্বাহীরা ও সাংবাদিকেরা এতোটাই নুয়ে পড়ে দুঃখপ্রকাশ করেছেন যে, মনে হচ্ছে পুরো প্রতিষ্ঠানটি একটি কালো কাপড়ে ঢাকা পড়েছে।
ডায়ানার সাক্ষাৎকার নিতে তার ভাইকে ধোঁকা দিতে জাল ব্যাংক স্টেটমেন্ট তৈরি না করলেও ডায়ানা হয়তো এমনিতেই সাক্ষাৎকারটি দিতেন- শুধু এই পয়েন্টটি তুলে ধরে বশির বা বিবিসির কর্মকাণ্ডের পক্ষে কোনো সাফাই দেওয়ার চেষ্টা কেউ করছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের সমপ্রচার মাধ্যম সিএসবির সাবেক প্রেসিডেন্ট হাওয়ার্ড স্ট্রিংগার বলেন, ‘বিবিসির জন্য এটা আরও কঠিন। কারণ সবকিছুই ঘটছে লন্ডনে এবং একটি অনুবীক্ষণযন্ত্রের নীচে। যুক্তরাষ্ট্রে আপনি ওয়াশিংটনের তরফ থেকে চাপ অনুভব করতে পারেন ঠিকই, কিন্তু সেটা এতোটা কাছে বা বিপদজনক মনে হয় না।’ বিবিসির মহাপরিচালক টিম ড্যাভির নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনার যে পরিস্থিতি তা বুঝতে পারেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, তিনি প্রতিষ্ঠানের বর্তমানের কর্মী এবং ২৫ বছরের পুরানো একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময়কার অনৈতিক আচরণের মধ্যে একটি দেয়াল তৈরি করতে চেষ্টা করছেন।’
বিবিসির গণমাধ্যম সম্পাদক অমল রঞ্জন বৃহস্পতিবারের রাত ১০টার সংবাদ অনুষ্ঠানে বলেন, এই সত্য উন্মোচন বিবিসিকে দারুনভাবে আঘাত করেছে এবং এই ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াতে হবে প্রতিষ্ঠানটিকে। তিনি বলেন, বিবিসি সরকারকে আহত করেছে, সাংবাদিকতাকে আহত করেছে, আঘাত দিয়েছে বেতার-আলোচনার সঞ্চালকদের, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, একজন ভবিষ্যৎ রাজা, প্রিন্স উইলিয়াম ও তার ভাই প্রিন্স হ্যারিকে- এটা মনে রাখতে হবে। দীর্ঘ দিন ধরে জনগণের কাছে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অবস্থান থেকে নেমে যাওয়া বিবিসির জন্য কষ্টদায়ক হবে।’
আগামী বছর শতবর্ষ উদযাপনের জন্য প্রস্তুতিতে থাকা বিবিসিকে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বিদ্ধ করেছে প্রিন্স উইলিয়ামের সমালোচনা। গণমাধ্যম বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর আগেই রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে মরিয়া হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে এতোসব কিছুর পরেও বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই সংবাদ মাধ্যমটিতে এই ঝড়ের তোড়ে যে খুব বড় কোনো পরিবর্তন আসতে পারে তা খুব স্পষ্ট নয়। ব্রিটিশ সংস্কৃতিমন্ত্রী অলিভার ডডেন বিবিসির তীব্র সমালোচনা করলেও সরকারের পক্ষ থেকে এর লাইসেন্স ফি পরিশোধের ব্যবস্থা বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না বলে জানুয়ারিতেই আশ্বাস দিয়ে রাখা হয়েছে। সেটা হলে বিবিসির বাজেট ১০ শতাংশ কাটা পড়তো। ফলে বড় ধরনের সংকোচন নীতি অনুসরণ করতে হতে পারতো বিবিসিকে।
এতোখানি ব্যর্থতা শিকার করার পরেও সে দেশে বিবিসি এখনও আস্থার জায়গাতেই আছে এবং বিদেশেও এর গুরুত্ব কমেনি, যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে বর্তমানের কঠিন ঝড়ো পরিস্থিতি হয়তো সামলে উঠতে পারবে প্রতিষ্ঠানটি।