নতুন চট্টগ্রামকে দেখবে বিশ্বের মানুষ : চাই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা

ববি বড়ুয়া | শনিবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২৩ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

শিশির ভেজা ভোরের পথে নিজস্ব গতিতে চলাচল করতে থাকা হাওয়া ভেদ করে এগিয়ে চলা আমাদের চালকের নিপুণ হাতের গাড়ি। উঠতি সূর্যের আলোয় ঝিকঝিক করতে থাকা সবুজের আন্দোলন। মৃদু মন্দ গানের সুর দোলা লাগানো মনে আরও বেশি তাল তোলে পাল লাগানো মনের তরীতে। বায়েজিদ লিংক রোডের দুপাশের পাহাড় ভেদী পথ ধরে প্রায়শই ছুটে যাই, কখনো পড়ন্ত বিকেলে কখনো পূর্ণিমার রাতে। কখনো শীতের হিমেল হাওয়ায় ভারী জামা গায়ে জড়িয়ে, কখনো ঝুম বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের তালে কিংবা কখনো কখনো বসন্তের মাতাল হাওয়ায় মনকে বাতাসে উড়িয়ে। বলা চলে এই পথের প্রেমে বুদ হয়ে থাকা মানুষ আমি। আর এই পথের মোড় ঘুরেই মেরিন ড্রাইভ ধরে সমুদ্রকে এক একদিন এক এক রঙে রঙিন হতে দেখতে। আহা! কী অদ্ভুত সুন্দর সেই প্রকৃতি মাতার নিপুণ হাতে ঢেলে সাজানো সমুদ্রের সৌন্দর্য। সে যে মনকে কখন কোন খেয়ালে নিয়ে যায় তা নিজেরই অজানা। যেন মনের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ এই প্রকৃতি রানী নিজের দখলে নিয়েছেন কোনো এক সময়ের ঋণ শোধের অপারগতার অপরাধে। যাই হোক, এই মনটাকে প্রকৃতি মাতার হাতে সঁপে দিয়ে কখনো ঠকেছি বলে আজৌ মনে হয়নি। শুনেছিলাম সমুদ্রের পার ঘেঁষে তৈরি হবে বঙ্গবন্ধু টানেল। আর এজন্য ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনও করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন। প্রকল্পটি ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধনের পর থেকে সমুদ্র পারে গেলেই প্রকৃতির হাতে সমর্পিত এই ভ্রমণ পিপাসু মনটি অস্থির হয়েছে কতো শত বার। কখন এটি দৃশ্যমান হবে? কখন তাকে দেখবো দু’নয়ন ভরে? কখন এটি ভেদ করে ওপারে পৌঁছানো যাবে? মনে আছে ২০১৯ সালে চায়না বেড়াতে গেলে সাংহাইতে নদীর ভেতরে এমনই সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে ওপারে পৌঁছেছিলাম ওখানকার দোতলা ট্যুরিস্ট বাস ‘হপহপ’ করে। তখন মনে ভাবতাম কখনোও কি এমন একটি সুরঙ্গ পথ দিয়ে আমাদের বাংলাদেশের মানুষের যাওয়ার সৌভাগ্য হবে? কখনো কি বাস্তবায়িত হবে বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্প? অস্থির ব্যাকুল এই মনটার সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এসে উদ্বোধন করে গেলেন আমার বহু দিনের প্রতীক্ষিত টানেল। সেদিন জনসাধারণের উল্লাস উদ্দীপনা দেখে বুঝতে বাকি রইলো না কর্ণফুলির উত্তর প্রান্তে চট্টগ্রাম বন্দরনগরীকে নদীর দক্ষিণে আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে যুক্ত করা এই টানেলটি শুধু আমার একারই কাঙ্ক্ষিত ছিলো না; ছিলো চট্টগ্রাম নগরী সহ সমগ্র বাংলাদেশের মানুষেরও। আর এই আয়োজন যে শুধু আমার মতো ভ্রমণ পিপাসু মানুষের ভ্রমণের সুবিধার্থে তা কিন্তু না। এটি খুলে দিয়েছে দেশের অর্থনীতির সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। নতুন সম্ভানায় দেশ এখন এগিয়ে যাবে অর্থনীতির স্বাস্থ্যকে পরিপুষ্ট করে। দেশের দুই অঞ্চলকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর পর ৩.৩২ কিলোমিটার টানেল সড়ক পরিবহন খাতে দ্বিতীয় ‘ড্রিম প্রজেক্ট’টি চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেল অনুসরণ করে টানেলটি তৈরি করা হয়েছে। এতে করে ঢাকাচট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের সঙ্গে নতুন একটি সড়ক যোগাযোগ চালু হলো। ফলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার দূরত্ব কমে আসবে। যাতে করে মানুষের সময়, অর্থ এবং শ্রম সবটাই সাশ্রয় হবে। এতে ভারী যানবাহনও সহজে টানেলের মধ্যদিয়ে চলাচল করতে পারে। অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন ভবিষ্যতে এ টানেল এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের উন্নতি এবং বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশি দেশগুলোর যোগাযোগ জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গুরুত্ব বিবেচনায় ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘টানেলটি অর্থনীতি, যোগাযোগ ও পর্যটনে ব্যাপক অবদান রাখবে। এটি হবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি উন্নত বাংলাদেশের রোডম্যাপ’। ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ও বন্দরনগরী থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে মিরসরাইয়ে ৩৩ হাজার ৮০৫ একর জমির ওপর গড়ে উঠছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। এটি উপকূল বরাবর মেরিন ড্রাইভের মাধ্যমে টানেলের সঙ্গে যুক্ত হবে। মেরিন ড্রাইভটি পরবর্তীতে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে। যা সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি এ এলাকার শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করবে। কর্ণফুলির দক্ষিণ পাশে আড়াই হাজার একর জমিতে কোরিয়ান ইপিজেডের ৩৮টি কারখানা এ টানেলের সুবিধা পাবে। এখন কোরিয়ান ইপিজেড প্রতি বছর দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। যদিও এখনো এই ইপিজেডের ৭০ শতাংশ জমি অব্যবহৃত রয়ে গেছে। আর কোরিয়ান ইপিজেডের পাশেই চায়না ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। ২০১৬ সালে আনোয়ারায় ৭৫৩ একর জমিতে এটি উদ্বোধন করা হলেও ভূমি উন্নয়নের কাজ এখনো শেষ হয়নি। বেপজার তথ্য অনুসারে, এ জোনটি চালু হলে ৩৭১ টি কারখানা স্থাপন করা হবে এবং ১৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পাশাপাশি ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তবে ২৩০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর জোর না দিলে টানেলের সর্বোচ্চ ব্যবহার হবে না।একই সাথে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও বে টার্মিনালসহ এই শিল্প অঞ্চলগুলো পুরোপুরি চালু হলে টানেলের পূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে এটা নিশ্চিত বলা যায় এবং মেরিন ড্রাইভের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যাবে। একই সঙ্গে মিরসরাই থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চল একটি অর্থনৈতিক বিপ্লবের সুতিকাগারে রূপান্তরিত হবে। ওপরের সব আলোচনার বিষয়বস্তুকে যদি নজরে দেখি অর্থাৎ এর সারাংশ গিয়ে দাঁড়ায় ঠিক এরকমকর্ণফুলি নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে। এক ভাগে রয়েছে নগর ও বন্দর এবং অপর ভাগে রয়েছে ভারী শিল্প এলাকা। এই টানেল চট্টগ্রাম বন্দর নগরকে কর্ণফুলি নদীর অপর পাড়ের সাথে সরাসরি যুক্ত করেছে। পরোক্ষভাবে ঢাকাচট্টগ্রামকক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে সারা দেশের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। কর্ণফুলি টানেল নির্মিত হওয়ায় এলাকার আশে পাশে শিল্পোন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। ফলে দারিদ্র দূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে। সরকারি হিসেবে টানলটি জিডিপিতে বার্ষিক ০.১৬৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করবে। আর এই কাঙ্ক্ষিত টানেল উদ্বোধনের ভালো লাগার ঘোর কাটতে না কাটতেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ নভেম্বর বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে বহুল প্রতীক্ষিত দোহাজারীকক্সবাজার দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশনেরও উদ্বোধন করেছেন। এখন পাহাড়ের নীরবতা, ঝাউয়ের বনে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, নীল আকাশ আর সমুদ্রের টানা গর্জনের সাথে মিলে মিশে একাকার হতে যাচ্ছে ট্রেনের হুইসল। আবার ১৪ নভেম্বর তারিখ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীসিডিএ ফ্লাইওভার’ নামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ ১৭টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করেন। চট্টগ্রামে প্রচলিত একটা কথা ছিলো – ‘চট্টগ্রাম কিন্তু আসলেই একটা গ্রাম।’ কিন্তু এখন সেই কথাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে একের পর এক চমকে চমকিত হচ্ছে চট্টগ্রামবাসী। যেন এক নতুন চট্টগ্রামকে দেখবে বিশ্বের মানুষ। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চট্টগ্রামের মানুষের পক্ষ থেকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই। তবে দুঃখজনক হলেও একথা সত্যি যে, টানেলটি উদ্বোধনের পরপরই ইতিমধ্যে অতি উৎসাহী মানুষের অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালনায় দুর্ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে অনেক। তাই এ জন্য যেমন এসব উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করণে সরকারি নানামুখী ত্বরিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন; তেমনি আমরা যারা এই প্রকল্পের সুদূরপ্রসারী সুবিধা ভোগী সাধারণ মানুষ; আমাদের এসব প্রকল্প সুরক্ষায় অধিকতর যত্নশীল মনোভাব প্রয়োজন। কারণ সাধারণ মানুষ যদি এসবের প্রতি মমত্ববোধ ও সচেতনতা না থাকলে তবে তা সুদূরপ্রসারী সুফল হতে ব্যত্যয় ঘটবে। ওপরের সকল প্রকল্পগুলো যেমন অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করবে তেমনি পর্যটন শিল্পের জন্য অবারিত দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। এখন দেশের যেকোনও প্রান্ত হতে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত দেখার পথ হবে বেগহীন ও আরও রোমাঞ্চকর। পরিশেষে একটা কথা বলতে বারবার আনচান করে; তা হলো– ‘ভালোবাসি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তোমাকে। অনেক ভালোবাসি। চঞ্চল এই মনে শান্তির পরশ বুলাতে আমরা তোমাকেই চাই। বারবার প্রতিবার।’

লেখক : প্রাবন্ধিক; শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, ওমরগণি এমইএস কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধষাট দশকের ছাত্র-আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ
পরবর্তী নিবন্ধচন্দনাইশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন : সমস্যা ও সম্ভাবনা