নগরীতে মোটরসাইকেল চোর চক্রের অন্তত নয়টি গ্রুপের সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা মোটরসাইকেল দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রির পাশাপাশি সীমান্তে নিরাপত্তা রক্ষীদের সতর্ক প্রহরা ডিঙিয়ে পার্শ্ববর্তী ভারত ও মিয়ানমারে পাচার করে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তারকৃত মোটরসাইকেল চোর চক্রের সদস্যরা চাঞ্চল্যকর এ তথ্য জানান। খোদ পুলিশ কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে, চুরি ঠেকাতে বিশেষ অভিযান চলার ফাঁকেও প্রতিদিন নগরীতে তিন/চারটি মোটরসাইকেল ঠিকই চুরি হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চোরের দল মোটরসাইকেল চুরিতে সব সময় নতুনগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বিক্রির সময় তারা জানায়, ভারত থেকে চোরাপথে এনেছে বলে দাম কম। কাগজপত্র নিজেদের করে নিতে হবে। পার্টি মোটরসাইকেলটি চোরাই বলে লাভের লোভে গোপনে তা কিনে নেয়।
পুলিশ জানিয়েছে, প্রতিটি চক্রে প্রায় ১৫-২০ জন সদস্য আছে। তাদের অধিকাংশই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছদ্মনাম পরিচয় দিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকে। এরপর সুযোগ বুঝে মোটরসাইকেল চুরি করে। চাবি ছাড়াই তালা খুলে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিতে পারে তারা। এতে সময় লাগে মাত্র ১০ থেকে ২০ সেকেন্ড। গ্রেপ্তারকৃতদের তথ্য মতে এ বিদ্যা রপ্ত করেছে তারা ইউটিউব দেখে। কেউ আবার মেকানিকদের কাছ থেকে। নগরী ছাড়াও বিভিন্ন জেলা থেকে মোটরসাইকেল চুরি করে তারা। মাত্র ২০ সেকেন্ডের মধ্যেই মোটরসাইকেলটি স্টার্ট দিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায় তারা। সেখানে তারা নম্বর প্লেট ও চ্যাসিস নম্বর পাল্টে ফেলে। এর পর অন্য জেলায় বিক্রি করে দেয়। চোরাই মোটরসাইকেলগুলো বিক্রি করতে তাদের আলাদা সিন্ডিকেট রয়েছে। সচরাচর ক্রেতাদের বলে বর্ডার ক্রস হওয়ায় দাম কম। আবার মোটরসাইকেল একেবারে নতুন হলে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে চুরি হওয়া মোটরসাইকলেগুলোতে নতুন পলি স্টিকার লাগানো হয়। বলা হয় কাস্টমসের নিলাম থেকে কেনা হয়েছে। এরপর ভুয়া কাগজ বানিয়ে, ভুয়া কাস্টমস নম্বর ও জিআর নম্বর দিয়ে প্রতারণা করে বিক্রি করা হয়। নগরী থেকে চুরি করা মোটর সাইকেল বিক্রি হয় সন্দ্বীপ, নোয়াখালী, ফেনী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যেখানে পুলিশের তেমন তৎপরতা নেই। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে চুরি করা মোটরসাইকেল একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যেতে মোটরসাইকেলে প্রেস স্টিকার ব্যবহার করে তারা।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার মুহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, এক জেলা থেকে চুরি করা মোটরসাইকেল অন্য জেলায় বিক্রি করে তারা। চট্টগ্রামের আশপাশের প্রতিটি জেলায় তাদের লোক রয়েছে। তারা একটি সংঘবদ্ধ চক্র। কয়েক মাসে অন্তত অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেল চুরি করে একেকটি চক্র। গাড়ি চুরির ঘটনার মধ্যে ৮০ শতাংশই মোটরসাইকলে চুরি সংক্রান্ত ঘটনা বলেও জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, চক্রের সদস্যরা কয়েকটি ভাগে কাজ করে। এর মধ্যে একটি অংশ মোটর সাইকেল চুরি করে। অপর একটি অংশ চোরাই মোটর সাইকেলগুলো চালিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায়। সেসব স্থানে এগুলো বিক্রি করার জন্য চক্রের লোক থাকে। যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো যায় সেসব স্থানে চোরাই মোটরসাইকেলগুলো বিক্রি হয়ে থাকে।
সিএমপির উপ-কমিশনার (পশ্চিম) মো. আব্দুল ওয়ারিশ খান জানান, তারা পরিবহনের চালক-সহকারীর পরিচয়ে নগরীতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। চক্রের কয়েকজন সদস্য মোটরসাইকেল চুরি করে। দিনের বেলায় বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে বাসার নিচে নিয়মিত রাখা মোটরসাইকেলের তথ্য সংগ্রহ করে। সুযোগ বুঝে মাত্র ২০ সেকেন্ডে চুরি করে একটি মোটরসাইকেল। এর মধ্যে প্রথমে ১০ সেকেন্ড লাগে মোটরসাইকেলের লক ভাঙতে আর বাকি ১০ সেকেন্ড চাবির তার ছিঁড়ে জোড়া দিয়ে গাড়ি চালু করতে।
সর্বশেষ গত ২৩ জুন পিবিআই, চট্টগ্রাম মেট্রো পাঁচলাইশ থেকে চুরি যাওয়া একটি মোটরসাইকেল কঙবাজার থেকে উদ্ধার করেছে। এসময় সজীব (১৯) নামে মোটরসাইকেল চোর চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুক্রবার (২৪ জুন) দুপুরে পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম (মেট্টো) ইন্সপেক্টর আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক এ তথ্য জানান।
গত ২০ জুন বন্দর থানা পুলিশ মোটর সাইকেল চোর চক্রের অপর একটি গ্রুপের তিন জনকে গ্রেপ্তার করে, যেটির নেতৃত্ব দেয় ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর। মোটরসাইকেল চুরিতে তার দক্ষতায় বিস্মিত পুলিশও। সিএমপি বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহেদুল কবির জানান, ধরা পড়া কিশোরের কাজ চুরি করা পর্যন্তই। এ কাজে সে পায় মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। চুরি করা মোটরসাইকেল তুলে দেয় চক্রের আনেক সদস্য সাজ্জাদের হাতে। পটিয়ায় নিজের গ্যারেজে কয়েক মিনিটে রং, চেসিস, নম্বর প্লেট পাল্টে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করেন তিনি।
২৯ এপ্রিল নগরীতে এক ‘মোটর সাইকেল চোরকে’ হাতেনাতে গ্রেপ্তারের পর তার দেওয়া তথ্যে ধরা পড়েছে আরও চার জন; যাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের পাঁচটি মোটর সাইকেল। তাদের সবার বাড়ি সীতাকুন্ড উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। বায়েজিদ থানার ওসি কামরুজ্জামান বলেন, সাকিব বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শেরাশাহ এলাকা থেকে এক ব্যক্তির মোটর সাইকেল চুরি করে পালানোর সময় পড়ে গিয়ে স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়ে। পরে তার দেওয়া তথ্যে অন্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। সাকিব পেশাদার মোটর সাইকেল চোর। গত ফেব্রুয়ারি মাসেও একটি মোটর সাইকেল চুরির ঘটনায় সে বায়েজিদ থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। সাকিব, মিরাজ ও আজাদ বিভিন্ন স্থান থেকে মোটর সাইকেল চুরি করে সোহেলের কাছে দিত। সোহেল সেগুলো রাব্বী, পারভেজ ও পলাতক কামরুল ও সাকিব নামে আরেকজনের মাধ্যমে রঙ এবং ইঞ্জিন ও চেসিসের নম্বর পাল্টে বিক্রি করত।
১ এপ্রিল রাঙ্গুনিয়া ও নগরীতে অভিযান চালিয়ে মোটরসাইকেল চোর চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জাহিদুল কবির বলেন, তারা প্রায় ৫ বছর ধরে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মোটরসাইকেল চুরি করে আসছিল। ১৬ মার্চ সীতাকুণ্ড থানায় মোটরসাইকেল চুরির একটি অভিযোগ পেয়ে বিশেষ অভিযানে নামে থানা পুলিশের টিম। সফল হয় অভিযান। চোরাই মোটরসাইকেলটি উদ্ধারের পাশাপাশি আটক হয় সংঘবদ্ধ চক্রের ২ সদস্য।
২৭ ফেব্রুয়ারি নগরীতে মোটরসাইকেল চুরির সঙ্গে জড়িত একটি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি গোপন খবরের ভিত্তিতে হালিশহর থানার মাদার্য্যপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে চক্রের মো. আলমগীর হোসেন ও মো. নাহিদুল ইসলামকে একটি মোটরসাইকেলসহ আটক করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের কিনারা এলাকায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় মো. মন্নান নামে একজনকে আটক করা হয়। তার দোকান থেকে ৩টি চোরাই মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর চৌদ্দগ্রাম থেকে মো. বাবুল মিয়াকে আটক করা হয়। এ সময় তার বসতঘর থেকে ৪টি চোরাই মোটর সাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। পরে সীতাকুণ্ডে অভিযান পরিচালনা করে আব্দুল মালেক সোহাগ নামে একজনকে একটি মোটর সাইকেলসহ আটক করা হয়েছে।
১০ ফেব্রুয়ারি নগর গোয়েন্দা (উত্তর) পুলিশ টানা দুই দিনের অভিযানে খুলশী, ডবলমুরিং থানাসহ ফেনী জেলার সোনাগাজী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আটজনকে গ্রেপ্তার করে ও পাঁচটি চোরাই মোটর সাইকেল উদ্ধার করে।
সিএমপিতে ভেহিক্যাল থ্যাফট এন্ড রিকভারি ডাটাবেইজ নামে একটি সফটওয়্যার চালু করা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। সফটওয়্যারটি উদ্বোধনের সময় নগর পুলিশের দাবি ছিলো, এ ডাটাবেজের মাধ্যমে উদ্ধারকৃত যানবাহনের সাথে চুরি হওয়া যানবাহনের মিল সহজে বের করা যাবে। চুরি কিংবা উদ্ধার সংক্রান্ত বছরওয়ারি পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে। চুরি কিংবা হারানো ও উদ্ধারকৃত যানবাহনের সময় ভিত্তিক গ্রাাফিক্যাল উপস্থাপন পাওয়া যাবে। উদ্ধারকৃত যানবাহনের সাথে হারানো কিংবা চুরি হওয়া যানবাহনের সাথে মিল পাওয়া গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও অভিযোগকারীর মোবাইলে এসএমএস চলে যাবে। এই সফটওয়্যারে চুরি হওয়া এবং হারানো মোটর সাইকেলসহ গাড়ির তথ্য, ইঞ্জিন নম্বর, চেসিস নম্বর, মালিকের নাম ও মোবাইল নম্বর জিডিমূলে দেয়া থাকবে। আবার দেশের যে কোনো স্থানে চোরাই গাড়ি উদ্ধারের পর সেই গাড়ির ইঞ্জিন নম্বর, চেসিস নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য ওই সফটওয়্যারে আপলোড করা হবে। চোরাই গাড়ির মালিকের তথ্য সফটওয়্যারে সংরক্ষিত থাকলে এবং তার মোবাইল নম্বর ঠিক থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই মোবাইলে একটি ম্যাসেজ পৌঁছে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ে।