নগরের ৪৭টি গ্যাংয়ে সক্রিয় ৫৩৫ কিশোর

ঋত্বিক নয়ন | শনিবার , ২ মার্চ, ২০২৪ at ৭:০০ পূর্বাহ্ণ

বয়স তাদের গড়ে ১৮ থেকে ২০ বছর। এলাকার মাদক বেচাকেনা, জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, ফুটপাতে হকার বাণিজ্য, মারামারি, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধতো আছেই; রমজান মাসকে কেন্দ্র করে তারা নেমে পড়ে ছিনতাই ও চাঁদাবাজিতে। এদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত হওয়ায় ছিনতাই করতে সামান্য বাধা পেলেই হাতে থাকা ধারালো ছুরি দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় ভিকটিমের শরীরের নানা অংশ। যাদের সর্বশেষ শিকার কলেজ ছাত্র ও শৌখিন ফটোগ্রাফার শাওন বড়ুয়া (২১)। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের ছবি তোলার কথা বলে ডেকে নেওয়া হয়েছিল তাকে। পথে তাঁর সঙ্গে থাকা দামি ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ সময় তিনি বাধা দিলে উপর্যপুরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয় শাওনকে। এ ঘটনার এক দিন পর গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বুধবার এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানায় পুলিশ। যাদের চারজনই শাওনের সমবয়সী প্রায়।

হিরোইজম, কাঁচা টাকাপয়সা, মাদকাসক্তি, সাংস্কৃতিক চর্চার নামে সস্তা ছেলেমেয়েদের অবাধে মেলামেশার তীব্র আকর্ষণ ইত্যাদি হাতছানি দিয়ে ডাকায় দ্রুত বাড়ছে কিশোর গ্যাং এবং তাদের সদস্য সংখ্যা। সেই সাথে টিকটক, লাইকি ইত্যাদি নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পথভ্রষ্ট হয়ে তরুণরা কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে। ফলে সমাজকে ভেতরে ভেতরে উইপোকার মতো খুবলে খেয়ে ফেলছে এই অশুভ চর্চা। কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা হালনাগাদ করার পাশাপাশি এই গ্যাং কালচার দমাতে তিন উপায়ে কাজ করার কথা ভাবছে পুলিশ। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় এ প্রসঙ্গে বলেন, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে, এসব খুন খারাবি বন্ধে আমরা তিনটি বিষয় নিয়ে কাজ করছি। এক. নতুন করে কিশোর গ্যাংয়ের সলিড তালিকা তৈরি করে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। দুই. কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত কিশোরদের অভিভাবকদের ডেকে এনে কাউন্সিলিং করা। তিন. এসব গ্যাং কালচারে যেসব কথিত বড় ভাইরা ছায়া হয়ে আছে তাদেরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আইনের আওতায় আনা।

র‌্যাব৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মাহবুব আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশে কিছু অপসংস্কৃতির প্রভাব ঘটেছে, তার একটি হচ্ছে কিশোর গ্যাং। অন্যান্য জেলার মতো চট্টগ্রাম মহানগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য রয়েছে। এর প্রেক্ষিতে কিশোর গ্যাংয়ের ওপর নজরদারি রাখার পাশাপাশি আমরা অভিযান শুরু করেছি। বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের যারা ধরা পড়ছে, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে পূর্বেকার মামলা রয়েছে। তিনি বলেন, এ অবক্ষয় রোধে পারিবারিকভাবে নৈতিক শিক্ষা আরও জোরদার এবং সন্তান কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশেএসব বিষয়ে অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে।

সর্বশেষ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৫টি কিশোর গ্যাং গ্রুপের প্রধানসহ ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এদের মধ্যে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ এলাকা থেকে নুরু গ্রুপের সদস্য রাকিব উদ্দিন তামিমসহ ৬ জন, আমিন কলোনি এলাকা থেকে রশিদ গ্রুপের প্রধান হারুনুর রশিদ, আকবর টিলা পূর্বাঞ্চল হাউজিং সোসাইটি এলাকা থেকে রুবেল গ্রুপের প্রধান রবিউল আওয়াল রুবেলসহ ৭ জন, বাকলিয়া থানার এক্সেস রোড এলাকা থেকে ইউসুফ গ্রুপের প্রধান ইউসুফসহ ৫ জন, পাহাড়তলীর সাগরিকা মোড় এলাকা থেকে সাদ্দাম গ্রুপের প্রধান রকিবুল হোসেন ওরফে সাদ্দামসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত দুই ডজন খুনের সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িত বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। কর্মকর্তারা বলছেন, কিশোর অপরাধ দমন তাদের কাছে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে কিশোর অপরাধীদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতন করা হচ্ছে। তার পরও কিশোর অপরাধীদের দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না।

২০১৯ সালে করা সিএমপির তালিকায় বলা হয়েছিল সিএমপির কিশোর গ্যাংয়ে মোট কিশোরের সংখ্যা ৫৩৫ জন। আর তাদের গ্যাংয়ের সংখ্যা ৪৭টি। সেই তালিকানুযায়ী ডবলমুরিং থানায় গ্রুপের সংখ্যা ৭টি ও সদস্য সংখ্যা ৪৫ জন। পাহাড়তলী থানায় সদস্য সংখ্যা ২২ জন ও গ্রুপের সংখ্যা ৩টি। হালিশহর থানায় গ্রুপের সংখ্যা ২টি আর সদস্য সংখ্যা ১৩ জন। আকবর শাহ থানায় সদস্য সংখ্যা ১৩ জন আর গ্রুপ হচ্ছে ২টি। ইপিজেড থানায় গ্রুপের সংখ্যা একটি আর সদস্য সংখ্যা ৮ জন। বন্দর থানায় গ্রুপের সংখ্যা ৩টি এবং সদস্য সংখ্যা ৩০ জন। কোতোয়ালী থানায় সদস্য সংখ্যা ১৫০ জন ও গ্রুপের সংখ্যা ৪টি। বাকলিয়া থানার গ্রুপের সংখ্যা ৩টি আর সদস্য সংখ্যা ১৮ জন। চকবাজারে গ্রুপের সংখ্যা ৭টি ও সদস্য সংখ্যা ১১৮ জন। সদরঘাট থানায় গ্রুপের সংখ্যা ২টি ও সদস্য সংখ্যা ৩০ জন। চান্দগাঁও থানায় গ্রুপের সংখ্যা ২টি ও সদস্য সংখ্যা ৩০ জন। পাঁচলাইশ থানায় সদস্য সংখ্যা ১৮ জন ও গ্রুপের সংখ্যা ৩টি। খুলশী থানায় গ্রুপের সংখ্যা ৬টি আর সদস্য সংখ্যা ৩২ জন। বায়েজিদ থানায় গ্রুপ ২টি এবং সদস্য সংখ্যা আট। কর্ণফুলী ও পতেঙ্গায় কোনও কিশোর গ্যাং নেই বলে দাবি করেছিল পুলিশ। সিএমপি সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৮ সালে কোতোয়ালী থানার জামালখানে আদনান হত্যার পর পুলিশ অপরাধপ্রবণ এলাকার তালিকা করেছিল। যেখানে নিয়মিত বসে আড্ডা দেয় সে রকম অপরাধপ্রবণ স্পটের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০০টি। কোচিংভিত্তিক, রাজনৈতিক, স্কুলকলেজভিত্তিক, চাকরিজীবী এই ধরনের অন্তত ১৫টি ক্যাটাগরির আড্ডার এই ৩০০ স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাড়ি ফেরার দিন আজ
পরবর্তী নিবন্ধসন্দ্বীপ হচ্ছে অত্যাধুনিক ‘জয় সেট সেন্টার’