নগরের শব্দ দূষণ এবং এর প্রভাব

ড. নারায়ন বৈদ্য | মঙ্গলবার , ৩০ জুলাই, ২০২৪ at ১১:১২ পূর্বাহ্ণ

দূষণ শব্দটি অর্থ হলো বিষাক্ত। এ শব্দটি বিভিন্ন শব্দের পাশে বসে একটি অর্থ প্রকাশ করে। যেমনপানি দূষণ, বায়ু দূষণ, নদী দূষণ, শব্দ দূষণ, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি। প্রতিটি দূষণ মানুষের চলমান জীবন ধারাকে প্রভাবিত করে। এসব দূষণের ফলে মানুষ স্বাভাবিক প্রকৃতিতে বিচরণ করতে পারে না। ফলে মানুষের জীবন ধারায় বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এক একটি দূষণ মানুষের জীবন ব্যবস্থাকে এক একভাবে ক্ষতি করে। যেমনপানি দূষণ দ্বারা মানুষ ডায়রিয়া, কলেরা ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়। বায়ু দূষণ দ্বারা হৃদরোগ, যকৃতের রোগ, গুটি বসন্ত, হাম ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। শব্দ দূষণ দ্বারা মস্তিস্কের রোগ, কানে কম শোনা, মাথা ঝিমঝিম করা, লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়া ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

বিশ্বের অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশ যেন প্রতিযোগী হয়ে পানি দূষণ, শব্দ দূষণ এবং পরিবেশ দূষণ করে যাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে এসব দেশসমূহে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শব্দ দূষণের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ একটু সচেতন হলেই শব্দ দূষণের মাত্রাকে কমিয়ে আনা সম্ভব। এই এশিয়াতেই বেশ কয়েকটি দেশে শব্দ দূষণের মাত্রাকে তারা অনেকাংশে কমিয়ে এনেছে। কোন কোন দেশে শব্দ দূষণ নেই বললেই চলে। এসব দেশের মানুষদের মধ্যে এমন স্বভাব গড়ে উঠেছে যে, তারা ইচ্ছা করে তো নয়ই, বরং অনিচ্ছা সত্ত্বেও শব্দ দূষণ করে না। গত বছর আমরা স্বপরিবারে সিংঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। যে দিন সিঙ্গাপুর বিমান বন্দরে নামলাম, দেখলাম শত শত যাত্রী। তেমন কোন শব্দ নেই। নিঃশব্দে সবাই চলাচল করছে। কথা বললেও খুবই ছোট করে কথা বলে। আমরা সিঙ্গাপুরের ই ভিসা নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পাসপোর্টে ভিসার কোন চিহ্ন ছিল না। সিঙ্গাপুর বিমান বন্দর নেমে আমি অনেকটা দুর্বল মন নিয়ে আউট গোয়িং ডেসপাস রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। অবাক কাণ্ড। আমাদের পাসপোর্টে সিঙ্গাপুর বিমান বন্দর কোন প্রকার সীল মারেনি। তিন দিন পর যখন সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া যাচ্ছি, সে সময়ও সিঙ্গাপুর বিমান বন্দরে আমাদের পাসপোর্টে কোন সীল মারেনি। অর্থাৎ আমরা যে সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করলাম তার কোন প্রমাণ পাসপোর্টে নেই। কত নীরবতার ভেতর দিয়ে সিঙ্গাপুর চলে তা ভ্রমণ না করলে বুঝা যায় না। শুধুমাত্র আমাদের পাসপোর্টগুলো দেখে খুব ছোট করে একজন অফিসার ইংরেজিতে বললো, ‘আপনাদের ট্যুর প্ল্যান?’ সাথে সাথে আমি তা বের করে দেয়াতে তিনি আমাদেরকে হাত দেখিয়ে সামনে যেতে বললেন। আমরা সরাসরি হেঁটে সামনের গেইট দিয়ে বের হয়ে গেলাম। শব্দ দূষণ একেবারেই নেই। আরো অবাক কাণ্ড, যে নোহা গাড়িটি করে আমরা আমাদের জন্য রিজার্ভ করা হোটেলে যাচ্ছি সেই গাড়িতে কোন হরণ নেই। সেই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছি যখন ৩০ মিনিট গাড়ি চলার পর আমরা আমাদের জন্য রিজার্ভকৃত হোটেলে পৌঁছলাম, তখন আমার ডাক্তার মেয়ে আমাকে বললো যে, রাস্তায় কোন গাড়ির হরণ শুনা গেল না। বোধহয় আমাদের এ গাড়িতেও কোন হরণ নেই। আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম। ড্রাইভার বললো, এখানে হরণের কোন প্রয়োজন নেই। এর পরের দুইদিন সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলাম। কোথাও কোন শব্দ দূষণের আলামত দেখলাম না। অর্থাৎ এ দেশটি শব্দ দূষণকে অনেকাংশে হ্রাস করতে পেরেছে।

স্বপরিবারে সিঙ্গাপুরে তিনদিন কাঠানোর পর রাওয়ানা হলাম মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে। বিমানে সিঙ্গাপুর ত্যাগ করে মালয়েশিয়ায় যখন পৌঁছলাম তখন মালয়েশিয়াকে সিঙ্গাপুর থেকে অনেকটা অপরিচ্ছন্ন মনে হলো। এখানেও গাড়িতে হরণ বাজানোর তেমন অভ্যাস নেই। তবে মাঝে মধ্যে কোন কোন গাড়িতে দুই একটা হরণ হঠাৎ করে বাজাতে শুনেছি। তবুও আমাদের দেশ থেকে অনেকাংশে কম।

শব্দ দূষণকে সাধারণত ডেসিবেল এ হিসাব করা হয়। ডেসিবেল হচ্ছে শব্দ দূষণ পরিমাপের একক। বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রাম মহানগরীতে শব্দ দূষণের মাত্রা শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালকে নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বহু আগেই। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রা অনুযায়ী, হাসপাতাল এলাকায় শব্দের গ্রহণযোগ্য মান থাকার কথা ৪৫ ডেসিবেল। কিন্তু এ নীরব এলাকায় শব্দের মানমাত্রা পাওয়া যায় ৭২ ডেসিবেল। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য থেকে এ মানমাত্রা পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম শহরে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতি মাসে ৩০টি স্থানে শব্দের মানমাত্রা পরীক্ষা করে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন এলাকাকেও নীরব এলাকা বলে বিবেচনা করা হয়। নগরের চট্টগ্রাম কলেজ, সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এবং কাজেম আলী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অবস্থান কলেজ রোডে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, দিনের বেলায় এ এলাকায় শব্দের মানমাত্রা ৭১ ডেসিবেল। এভাবে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোন হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকাকোন স্থানই আর নীরব নেই। শব্দে অস্থির মনুষ্য ও প্রাণিকূল। মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণের কারণে শিশুদের শ্রুতিহীনতাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। শব্দের এই দূষণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট করেও কোন মাথা ব্যথা নেই। মাঝেমধ্যে দুই একটি অভিযান শেষ করে পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৭ সালে আটটি বিভাগীয় শব্দের মাত্রা পরিমাপবিষয়ক এক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত জরিপে দেখা যায়, চট্টগ্রামে ৯৫ ভাগ শব্দ দূষণের মূল উৎস গাড়ির হর্ণ। এরপর রয়েছে ফ্ল্যাটের বা অন্যান্য স্থানে চালুকৃত জেনারেটর, মাইক বাজানো, নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্র ইত্যাদি।

পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক চট্টগ্রাম শহরের যে ৩০টি স্থানে প্রতিমাসে শব্দের মানমাত্রা পরীক্ষা করা হয় তাতে দেখা যায় ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে পরিমাপকৃত শব্দ দূষণের মাত্রা অধিক। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রা অনুযায়ী শব্দের গ্রহণযোগ্য মান হয়হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪৫ ডেসিবেল, আবাসিক এলাকায় ৫০ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকায় ৬০ ডেসিবেল ও বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবেল। অথচ ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে অক্সিজেন মোড়ে শব্দের মানমাত্রা পাওয়া যায় ৮৩ থেকে ৮৪ ডেসিবেল। জিইসি ও ইপিজেড মোড়ে দুই মাসেই ছাড়িয়েছে ৮০ ডেসিবেল। আবাসিক এলাকার মধ্যে কল্পলোক, আমিরবাগ, হালিশহরে ৭০ থেকে ৭৩ ডেসিবেলের মধ্যে ওঠানামা করছে শব্দের মানমাত্রা। চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের সামনে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে শব্দের মানমাত্রা ছিল ৭৩ ডেসিবেল। একইভাবে নগরের সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে ৭২, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় এলাকায় ৬৮ ও পাঁচলাইশ এলাকায় ৭৩ ডেসিবেল। অবশ্য ২০১৭ সালে অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত চট্টগ্রামের জরিপ প্রতিবেদনে শব্দদূষণের মানমাত্রা আরো বেশি ছিল। তখন জাকির হোসেন সড়কের ডায়াবেটিক হাসপাতালের সামনে শব্দের মানমাত্রা ছিল ১৩২ দশমিক চার ডেসিবেল। এ ছাড়া বন্দর আবাসিক এলাকায় পাওয়া যায় ১৩০ ডেসিবেল ও ইপিজেড এলাকায় পাওয়া গিয়েছিল ১৩০ দশমিক ৬ ডেসিবেল। গাড়ির হর্ণের পর চট্টগ্রামের শব্দদূষণের জন্য ১৩ ভাগ জেনারেটরকে দায়ী করা হয়। এ ছাড়া ১০ ভাগ নির্মাণ কাজ, ৮ ভাগ জল, কারখানা ও ৫ ভাগ মিছিলসমাবেশ দায়ী করা হয়। গাড়ির হর্ণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে হাইড্রোলিক হর্ণ। হর্ণ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, চট্টগ্রামে বহদ্দারহাট ও অক্সিজেন মোড়ে গাড়ির হর্ণ বাজে বেশি। এ দুই জায়গায় হাইড্রোলিক হর্ণও বেশি বাজে। ফলে শব্দ দূষণের মাত্রাও এই দুই জায়গায় বেশি।

অথচ সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ ও শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী যে কোন মোটরযান নির্ধারিত শব্দমাত্রার অতিরিক্ত শব্দমাত্রা সৃষ্টিকারী কোন যন্ত্র, যন্ত্রাংশ বা হর্ণ মোটরযানে স্থাপন বা ব্যবহার করতে পারবে না। এই অপরাধের জন্য সড়ক পরিবহন আইনে অনাধিক তিন মাসের কারাদন্ড বা অনাধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড কিংবা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। আবার শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার ক্ষেত্রে এ ধরণের প্রথম অপরাধের জন্য এক মাসের কারাদন্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় অপরাধের ক্ষেত্রে ৬ মাসের কারাদন্ড এবং ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, পুলিশ বা বিআরটিএ নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেটকে এসব আইন প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। ইদানিং মোটর বাইক চালকরাও মোটর বাইকে হাইড্রোলিক হর্ণ লাগিয়ে বিকট শব্দে পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। পথচারী আপত্তি জানালে তাদের ওপর চড়াও হয়। যেন তিনি রাজা আর পথচারী হয় প্রজা। এই আমাদের বাংলাদেশ।

লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক; পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৃদ্ধাশ্রম কালচার : যার জন্য আমরাই দায়ী
পরবর্তী নিবন্ধগত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৭ জন করোনা আক্রান্ত