নগরের বাতাস অস্বাস্থ্যকর

মানদণ্ড রিপোর্ট ৫০ পর্যন্ত মান ভালো, গতকাল সুচক ছিল ১৭৫ । দূষণের মাত্রা বাড়ছে, মানা হচ্ছে না পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা

হাসান আকবর | সোমবার , ৩ নভেম্বর, ২০২৫ at ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

ধুলোবালির শহরে পরিণত হচ্ছে চট্টগ্রাম। নগরীর বিশেষ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকার অবস্থা শোচনীয়। গতকাল রোববার সকালে চট্টগ্রাম নগরীর বাতাসের মানদণ্ড রিপোর্ট তথা একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) সূচক ছিল ১৭৫, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত। শূন্য থেকে ৫০ হলে বাতাসের মান ভালো। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত হলে অস্বাস্থ্যকর ধরা হয়। নগরীর বাতাস অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রয়েছে। কিছু এলাকায় অবস্থা ভয়াবহ।

একিউআই সূচক পর্যালোচনায় স্পষ্ট হয়, নগরের বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়েছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে বাতাসে ধুলোবালির পরিমাণ এমনিতেই বেশি থাকে। বায়ুপ্রবাহ বেশি থাকলে ধূলিকণা, গাড়ি ও কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে বাতাসের মান খারাপ হতে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে লেগে থাকা যানজট, দীর্ঘদিনের পুরনো গাড়ি, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং শিল্পকারখানার নির্গত ধোঁয়া শহরের বাতাসের অবস্থা নাজুক করে তুলছে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, চট্টগ্রাম শহরের বাতাসের মান ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের খোঁড়াখুঁড়ি, বিশ বছরের বেশি পুরনো হাজার হাজার গাড়ি, শহরের ধারেকাছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ফ্লাইওভার নির্মাণসহ নানা কারণে বাতাসের উপর মারাত্মক রকমের চাপ পড়ছে। ব্যস্ততম সড়কগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে। যানজটে আটকা পড়া গাড়ির নির্গত ধোঁয়া শহরের বাতাস বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। এছাড়া কোনো কোনো এলাকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি গাড়ির চলাচল রাস্তাজুড়ে ধুলোর আস্তরণ তৈরি করছে; যা বাতাসে মিশে সার্বিক অবস্থা খারাপ করে ছাড়ছে। বিশেষ করে মাঝিরঘাট, স্ট্র্যান্ড রোড, বন্দর, হালিশহরসহ সন্নিহিত এলাকার বাতাসের মান অত্যন্ত খারাপ বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

শহরের বিভিন্ন এলাকায় ওয়াসার খোঁড়াখুড়ির কাজ চলছে। উন্মুক্ত ট্রাকে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের মাটি পরিবহন করা হচ্ছে। ফ্লাইওভারের কাজেও প্রচুর ধুলোবালি সৃষ্টি হচ্ছে। সবগুলো মূলত শহরের বাতাস নষ্ট করছে।

নগরবাসী বলছেন, শহরের বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর ধুলোবালি ওড়ে। বর্ষার সময় কম থাকলেও শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত ধুলোর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে, যা বাতাসের সহনীয় মানের চেয়ে কয়েক গুণ খারাপ অবস্থা সৃষ্টি করছে।

নগরীর মাঝিরঘাট এলাকার একজন বাসিন্দা গতকাল আজাদীকে বলেন, শুধু রাস্তায় নয়, বাড়িঘরেও থাকতে পারছি না। জানালা দিয়ে প্রচুর ধুলোবালি ঘরে ঢোকে। ঘরজুড়ে ধুলোর আস্তরণ। বাতাসে এত ধুলো, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের অবস্থা নাজুক হয়ে ওঠে। যাদের শ্বাসকষ্ট বা হাঁফানির মতো রোগ আছে তাদের ভোগান্তি অনেক বেশি।

সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, খোঁড়াখুঁড়ির কারনে প্রচুর ধুলোবালির সৃষ্টি হয়। আমরা প্রতিদিন সুইপিং গাড়ি দিয়ে ধুলোবালি পরিষ্কার করি। আমাদের সেবক বাহিনীও রাস্তা পরিষ্কার করে। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ ধুলো তৈরি হয় যে, পরিষ্কার করার অল্প সময় পরই আবার ধুলোর মিছিল শুরু হয়। শহরের বিশেষ কিছু এলাকার অবস্থা খারাপ বলে স্বীকার করেন তারা।

গতকাল সরেজমিনে মাঝিরঘাটের স্ট্র্যান্ড রোড, কমার্স কলেজ রোড, আগ্রাবাদ, বারিক বিল্ডিংসহ সন্নিহিত অঞ্চলে প্রচুর ধুলোবালি দেখা গেছে। গাড়িতে থাকলে সমস্যা না হলেও পথ চলতে গেলে শরীরে ধুলোর আস্তর টের পাওয়া যায়।

মাঝিরঘাটের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ধুলোর অত্যাচার এত বেশি যে, চোখ খুলে পথ চলা যায় না। ভয়াবহ অবস্থা। আমরা এই অত্যাচার থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। খানাখন্দে ভরে থাকা রাস্তা থেকেও প্রচুর ধুলোবালি সৃষ্টি হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সকালসন্ধ্যা যদি রাস্তায় পানি দেয়া যেত তাহলে পরিস্থিতি এত ভয়াবহ হতো না।

সূত্র বলেছে, পরিবেশ অধিদপ্তর বেশ আগে এই ধুলোবালি রোধে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। বায়ুর গুণগত মান রক্ষার্থে এতে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, নির্মাণকাজের চারপাশ ঢেকে রাখা ও পানি ছিটানো, রাস্তা খোঁড়ার সময় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঢেকে রাখা, স্টিল, রিরোলিং মিলস ও সিমেন্ট কারখানাগুলোয় বস্তুকণা নিয়ন্ত্রণমূলক যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও ধুলাবালি কমাতে বাড়ির চারপাশে সবুজায়ন করা, ইটভাটায় পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার, গাড়ি ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা, যানজট এড়াতে ট্রাফিক আইন মেনে চলা এবং দূষণ রোধে নিয়মিত মেইনটেন্যান্স করা। এসব নির্দেশনা খুব একটা অনুসরণ করা হয় না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নগরবাসী।

বিষয়টি নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা আজাদীকে বলেন, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে প্রচুর ধুলোবালি হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি এসব রোধ করার। তিনি ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্পের খোঁড়াখুঁড়ির কথা উল্লেখ করেন।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা রাস্তা খুঁড়ছি এ কথা ঠিক। তবে ঠিকাদারদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে, ঘের দেয়া ছাড়া কোনো জায়গা খোঁড়াখুঁড়ি করা যাবে না। ঠিকাদাররা ওভাবে কাজ করছেন। তবুও কিছু ধুলোবালির সৃষ্টি হচ্ছে বলে তিনি স্বীকার করেন।

চট্টগ্রামের বাতাসের মান ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে মন্তব্য করে পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু পেরে উঠি না। নিয়মিত পানি ছিটানো এবং যানজট নিরসন করা গেলে ধুলোবালির পরিমাণ কমে শহরে বাসযোগ্য বাতাসের প্রবাহ থাকত।

একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, বায়ুদূষণ খুবই মারাত্মক জিনিস। ধুলো এবং যানবাহনের ধোঁয়া ফুসফুসে ঢুকে শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানি সৃষ্টি করে, ঝুঁকি বাড়ায় হৃদরোগের। জ্বালানি তেল পোড়ানোর ধোঁয়া রক্তে অঙিজেন কমিয়ে মাথাব্যথা ও ক্লান্তি সৃষ্টি করে। গাড়ি এবং কলকারখানার ধোঁয়া চোখ জ্বালা, গলা ব্যথা এবং এসিড বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে, যা তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ধুলোবালি ও কেমিক্যাল দীর্ঘমেয়াদে শরীরে প্রবেশ করলে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবায়ু দূষণ রোধে একযোগে অভিযানে নামছে সংস্থাগুলো : পরিবেশ উপদেষ্টা
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশখালীতে পরিত্যক্ত ভবনে টমটম চালকের মরদেহ