গত রোববার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নগরের জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশনায় গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে করণীয়গুলো আগামী বর্ষার আগে অর্থাৎ মে মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে সময় ঠিক করে দেওয়া হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেন পরিষ্কারসহ ১১টি করণীয় নির্ধারণ করে তা শেষ করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে চার মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, নির্ধারিত করণীয়গুলো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), সিডিএ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিভাগীয় কমিশন, জেলা প্রশাসন, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে বাস্তবায়ন করতে হবে। যে সংস্থা পারবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান প্রকল্পের অর্থ ছাড় বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে।
বৈঠকে বক্তব্য রাখেন উচ্চ পর্যায়ের কমিটির তিন সদস্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম বীর প্রতীক। বক্তব্য রাখেন সিটি মেয়র ডা. শহাদাত হোসেন।
১১ করণীয়–এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম শহরে সকল ধরনের পাহাড় কাটা বন্ধ করা, শহরের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা, সিডিএ’র প্রকল্পের অধীনে নির্মাণাধীন ১৭টি স্লুইচ গেটের মধ্যে ১৫টি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পের অধীনে ২১টির মধ্যে ১২টি আগামী মে মাসের মধ্যে চালু করা। অন্যান্য করণীয়গুলোর মধ্যে আছে যত্রতত্র ময়লা ফেলা বন্ধে সিটি কর্পোরেশনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ, জলাবদ্ধতার হট স্পটগুলোতে পাম্প হাউজ চালুর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ, বারইপাড়া খাল খনন চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করা এবং খালটির খনন করা অংশে মে মাসের মধ্যে পরিষ্কার করা। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর প্রয়োজনীয় নাব্যতা ও গভীরতা বজায় রাখতে মেনটেনেন্স ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করা, আবর্জনা রিসাইকেলিংয়ের জন্য আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে মে মাসের মধ্যে পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া ও জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের বাইরে থাকা ২১ খাল নিয়ে ৩ মাসের মধ্যে প্রকল্প নেওয়া।
সিদ্ধান্তগুলো নিঃসন্দেহে চমৎকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে প্রকল্প শেষ করতে সময় বেঁধে দেওয়া। বলা হয়েছে, আগামী বর্ষার আগে অর্থাৎ মে মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, অন্যবারের চেয়ে এবারের উদ্যোগের পার্থক্য আছে। এবার যারা ফেল করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগে আমরা আলোচনা করেছি, এবার সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হবে। যেমন সেকেন্ডারি ড্রেন পরিষ্কারে জনউদ্যোগ যেটা নেওয়া হবে সেটা দেখার জন্য শিল্প এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান আসবেন। তিনি এসে কাজটা শুরু করবেন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রধানরা এসে মনিটরিং করবেন, যিনি ফেল করবেন তাকে দায় নিতে হবে।
বাস্তবিক অর্থে জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখগাথা হয়ে আছে। বর্ষা মৌসুমে ভারী কিংবা অল্প বৃষ্টিতে নগরের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে, এই নিয়তি একপ্রকার মেনে নিয়েছে নগরবাসী। বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলাবদ্ধতার মূল কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সময় জলপ্রবাহের যে রাস্তা ছিল তা বন্ধ করে দেয়া হয়। সে কারণেই জলাবদ্ধতার সমস্যা হচ্ছে। এর বাইরে এলাকা ভিত্তিকও নানা কারণ থাকতে পারে। জলাবদ্ধতার পেছনে পাহাড় কাটা, কর্ণফুলী নদী ভরাট হয়ে যাওয়া, খাল নালা দখল হওয়াসহ নানা কারণ আছে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা প্রশংসনীয়। নগরীর দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানে নগরবাসী প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রচুর সময় দিয়েছেন, সীমাহীন ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। এক মেয়র গিয়ে আরেক মেয়র আসেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেও এক চেয়ারম্যানের স্থলে আরেকজন চেয়ারম্যান আসেন। তবু নগরবাসীর দুঃখ ঘোচে না। উন্নয়নের নামে হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। অবসান ঘটে না চট্টগ্রামবাসীর প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতার। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের এই উদ্যোগের দিকে বড় আশা করে তাকিয়ে আছে চট্টগ্রামবাসী। আশা করি, বর্ষার আগে অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে।