শঙ্খ ঘোষের একটা বিখ্যাত কবিতা ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। কবিতায় কবি বলেন :
একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি তোমার জন্যে গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
শহরের মুখটাই ঢেকে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনে। গত ১৪ নভেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘সাইনবোর্ডে সৌন্দর্যহানি’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে, দিন দিন ‘অবৈধ’ সাইনবোর্ড, পোস্টার ও ব্যানার-ফেস্টুনে ভরে ওঠছে নগরী। এরমধ্যে প্রতি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ২৫০ অবৈধ সাইনবোর্ড হলেও পুরো শহরে এ সংখ্যা হবে ১০ হাজারের বেশি। প্রায় সমসংখ্যক রয়েছে ব্যানার-ফেস্টুনও। অবশ্য পোস্টারের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়তে পারে। যত্রতত্র স্থাপিত এসব প্রচারণামূলক সাইনবোর্ড, পোস্টার, ব্যানার-ফেস্টুনে একদিকে সৌন্দর্যহানি ঘটছে শহরের; অন্যদিকে খাতগুলো থেকে বছরে প্রায় কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পোস্টার লাগাতে চসিক থেকে ফি পরিশোধের মাধ্যমে অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা কেউ মানছেন না। আবার সাইনবোর্ডের জন্যও ফি ধার্য আছে। কোনো কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অনুমতি নিলেও অনুমতি পাওয়া সাইজের চেয়েও বড় আকারের সাইনবোর্ড স্থাপন করে তারা। আবার একটির অনুমতি নিয়ে একাধিক সাইনবোর্ডও স্থাপন করছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। সেক্ষেত্রে চসিকের কতিপয় পরিদর্শক অর্ার্থিক অনিয়মের মাধ্যমে এ ধরনের সুযোগ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। একইভাবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাথে লাগানো পরিচিতিমূলক শপসাইনের ক্ষেত্রেও ঘটছে এমন অনিয়ম। ব্যানার-ফেস্টুনের জন্য অনুমতি নেয়ার প্রবণতাও কম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটা সময় আজকের এই ব্যস্ত চট্টগ্রাম ছিল প্রকৃতির নিজ হাতে সাজানো এক নগরী। পাহাড়, নদী আর সমুদ্রে ঘেরা এই জনপদ ছিল আরও সবুজ আর জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর। পাখির কূজনে এই নগরীতে সকাল হতো আর সন্ধ্যেবেলায় পশ্চিমাকাশের আবীর ছুঁয়ে যেতো গোটা জনপদকে। পরে মানুষ বাড়লো, কমতে লাগলো গাছপালা আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়লো দালানকোঠা। স্রোতস্বীনি কর্ণফুলীর দু’পাশের অরণ্য হারিয়ে গেল আর সেখানে জায়গা করে নিল কলকারখানা। আজ ইট-পাথর আর কংক্রিটের রাজ্য হয়ে উঠেছে এই চট্টগ্রাম শহর। সেই ক্রমবর্ধিত শহরের নির্মাণযজ্ঞ এখন চলছে অতিমাত্রায়। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সৌন্দর্যহানির ঘটনা। পোস্টার ব্যানার সাইনবোর্ডের ছড়াছড়ি যত্রতত্র।
এছাড়া যেখানে-সেখানে, উন্মুক্ত স্থানে ময়লা-আবর্জনা, কফ, থুথু ও মলত্যাগে পরিবেশ দূষিত হয়ে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে। নোংরা ও দূষণযুক্ত পরিবেশ রোগব্যাধির প্রধান কারণ। তাই এসব দূষণযুক্ত পরিবেশের কবল থেকে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখলে মারাত্মক ও সংক্রামক রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে এসব নোংরা পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার ওপরই নির্ভর করে জনস্বাস্থ্যের সফলতা। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা ও দূষণ প্রতিরোধে সবার যথোচিত দায়িত্ব পালন করা উচিত।
আমরা জানি, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অনেকগুলো কাজের মধ্যে মূল দায়িত্ব তিনটি। রাস্তাঘাট নির্মাণ ও মেরামত, পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম পরিচালনা, শহর আলোকায়ন করা। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব আয়ে পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমসহ অন্যান্য অপরিহার্য সেবা শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাছাড়া ডাস্টবিন নির্মাণের জায়গা স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত ডাম্প ট্রাক, পরিচ্ছন্ন কর্মী স্বল্পতাসহ নানাবিধ সমস্যার কারণে বর্তমানে চলমান পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম জনগণের প্রত্যাশা পূরণে শতভাগ সক্ষম হচ্ছে না। কয়েক বছর আগে বিলবোর্ড অপসারণ করে নগরীর সৌন্দর্য রক্ষায় যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তার জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে অভিনন্দন জানিয়েছিল নগরবাসী। কিন্তু এখন নগরী আবার পরিণত হয়েছে জঞ্জালে। এর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে অ্যাকশনে নামতে হবে। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান অবৈধ সাইনবোর্ড ব্যবহার করে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে এবং নগরীর সৌন্দর্যহানি করছে, অনতিবিলম্বে সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। সাইনবোর্ড- বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলতে হবে। জনস্বার্থে একটা বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে এভাবে, সাত দিনের মধ্যে অবৈধ সাইনবোর্ড স্ব-উদ্যোগে সরিয়ে ফেলুন, নইলে সিটি কর্পোরেশন তা উচ্ছেদ করবে এবং জরিমানা প্রদান করবে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এখন চলছে ক্রান্তিকাল। প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন প্রচুর পরিশ্রম করছেন। তাঁর অনেক রুটিন কাজ। তবু নগরীর সৌন্দর্য রক্ষায় তাঁকে এ ব্যাপারে ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হবে।