চট্টগ্রামে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে ৪১ নারী ব্যবসায়ী। গত এক বছরে চট্টগ্রামে অপরাধ পর্যালোচনা এবং গ্রেপ্তারকৃত অপরাধীদের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে এ সত্য ধরা পড়ে। একদা ঘর–সংসার সামলাতো যে নারী, সে–ই এখন সংসারে সচ্ছলতা আনতে হয়ে উঠছে অপরাধপ্রবণ। দারিদ্রতা, অপরাধী হিসেবে নারীর প্রতি সন্দেহ তৈরি না হওয়া এবং অপরাধে জড়াতে পারে না এমন বিশ্বাসের সুযোগে ক্রমেই নারী অপরাধীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া নারীদের অপরাধ জগতে প্রবেশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের তেমন ধারণা নেই। তারা মূলত পরিবারের চাপে অপরাধে জড়ায়। এসব দিক বিবেচনা করে অপরাধ জগতে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সংশ্লিষ্টতাও বাড়ছে। গত এক বছরে চট্টগ্রামে গ্রেফতারকৃত নারী মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেউ স্বামী, কেউ বাবা–ভাইয়ের মাধ্যমে মাদক ব্যবসায় জড়িয়েছে বলে স্বীকার করেছে।
পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, দেশের মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৩০ শতাংশই নারী। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন নারী আবার মাদকের গডফাদার হিসেবেও তালিকাভুক্ত। তবে নারীদের সবচেয়ে বেশি মাদক বহনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু চট্টগ্রাম নগরীতেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অর্ধশতাধিক নারী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে ৪১ জন তালিকাভুক্ত নারী মাদক ব্যবসায়ীর নাম। এর মধ্যে অনেকেই পলাতক। আবার কয়েকজন কারাগারে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, নগরীর অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে সাধারণ এলাকাগুলোতে অসচ্ছল নারীদের পাশাপাশি আধুনিক–শিক্ষিত নারীরাও এখন মাদক বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত। এদের অনেকেই আছেন যারা স্বামীর চাপে পড়ে কিংবা তার অবর্তমানে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ওসি) এ বিষয়ের সাথে একমত পোষণ করেছেন। বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা এ বিষয়ে সহমত পোষণ করে আজাদীকে জানান, গত ২৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাতে ইয়াবাসহ আয়েশা আক্তার নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে বন্দর থানার তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি। তার বিরুদ্ধে ১৩টি মাদক ও একটি অস্ত্র মামলা রয়েছে।
কঙবাজার র্যাব–১৫ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক (ল’ এন্ড মিডিয়া) মো. আবু সালাম চৌধুরী জানান, গত ২৬ সেপ্টেম্বর, কঙবাজারের টেকনাফের লেজিরপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে এক লাখ ইয়াবাসহ নারী মাদক কারবারি রুজিনা আক্তারকে (৩০) আটক করে র্যাব–১৫। তিনি বলেন, রুজিনাকে আটক করা হলেও তার ভাই পালিয়ে যায়। রুজিনার দেওয়া তথ্য মতে খাটের নিচের সাদা রংয়ের প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে এক লাখ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, তারা ভাই–বোন বেশ কিছু দিন ধরে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নানাবিধ অভিনব পন্থায় কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা চালান সরবরাহ/বিক্রয় করে আসছে।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মোহাম্মদ ফেরদৌস জাহান জানান, বায়েজিদ থানায় মাদকের সবচেয়ে বড় স্পট নিয়ন্ত্রণ করে মাদক ব্যবসায়ী মুক্তা ও তার স্বামী হযরত আলী। দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিকভাবেই চলে আসছে তাদের মাদক ব্যবসা। তারা পেশি শক্তি খাটিয়ে দীর্ঘদিন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। মাদক ব্যবসা করে আসছে সিসি ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণে। মুক্তা এক সময় অসামাজিক ব্যবসা করলেও সে এখন সমাজের কোটিপতি মানুষদের মধ্যে একজন। মুক্তা ও তার স্বামী অবৈধ অস্ত্র দেখিয়ে মাদক ব্যবসার পাশাপাশি ভীতি সৃষ্টি করে টেন্ডারবাজি, গরুর হাট দখল এবং চাঁদাবাজি করে স্বনামে–বেনামে বিপুল অর্থবৈভবের মালিক হয়েছেন। সরেজমিনে ঘুরে আরও জানা গেছে, মুক্তার আপন মেয়ে খুচরা মাদক বিক্রেতা আঁখি প্রকাশ গাঁজা আঁখি। এই নারী ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় মাদকসহ বহু মামলা রয়েছে। মুক্তা ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারসহ মাদক বিক্রয় বন্ধ করার দাবিতে মানববন্ধন করেছেন এলাকার বাসিন্দারা বেশ কয়েকবার। মাদক ব্যবসায়ী স্বামী হযরত আলী প্রকাশ মাদক আলী’র হাত ধরেই মুক্তা মাদক ব্যবসায় আসে। প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার রয়েছে গভীর সখ্য। বেশ কয়েকবার জেলে গেলেও দ্রুত জামিনে বের হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে মুক্তা ও মাদক আলী।
মুক্তার সাথে আছে বেশ কিছু মাদক কারবারি রোহিঙ্গা, মুক্তার মাদক চক্রটি রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা এনে বায়েজিদ ও আরেফিন নগরে ইয়াবা ব্যবসা করছে, বলছেন অত্র এলাকাবাসী। মুক্তার দেবর ইয়াবা সোহাগের রয়েছে বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং। কেউ যদি মাদকের বিরুদ্ধে কিছু বলতে যায় ঠিক তখনই তাকে হতে হয় হামলার শিকার। বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মোহাম্মদ ফেরদৌস জাহান বলেন, আমার এলাকায় মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত সবাইকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।
গত ৩ মে নগরীর কর্ণফুলী দৌলতপুর এলাকায় এক আলিশান বাড়ির দোতলা থেকে কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী মোছা. মুনজুরাকে (৪৬) ৩০ কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব–৭, চট্টগ্রাম। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, সে ফেনী জেলার সীমান্ত এলাকা থেকে গাঁজা সংগ্রহ করে তার বর্তমান ভাড়া বাসায় রেখে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক সেবীদের নিকট বিক্রয় করে আসছে। উল্লেখ্য, গ্রেপ্তার আসামির পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। তার স্বামী এবং বোনকেও ইতোপূর্বে মাদকদ্রব্যসহ র্যাব গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। নগরীর আরও একজন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী চান্দগাঁও থানা এলাকার বাড়ইপাড়ার সাদিয়া বেগম। ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান। কিছুদিন পর জামিনে বেরিয়ে এসে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এখন তিনি নিজ এলাকায় হোসেন কলোনিতে একটি মাদকের স্পট চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সাদিয়ার মতো নগরের অধিকাংশ মাদক স্পট এখন সরাসরি নারীরা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। এসব নারীর কেউ কেউ দুই ডজন মামলার আসামিও।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নগরে ৪১ জন শীর্ষ নারী মাদক কারবারির মধ্যে একজন হলেন সাদিয়া। তার নামে মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে। চান্দগাঁও থানাধীন বাড়ইপাড়ার ‘হোসেন কলোনি’র মাদক স্পটের নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। তাকে সঙ্গ দিচ্ছেন তার স্বামী শাকিল।
চট্টগ্রামে গোয়ালপাড়ায় চিহ্নিত একটি মাদকের স্পট চালাচ্ছেন আরেক শীর্ষ কারবারি আকলিমা। তার নামে রয়েছে ১৮টির বেশি মামলা। এ পর্যন্ত জেলে গেছেন ২১ বার। একই ভাবে চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে গাঁজার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে সাহেদা নামে এক মাদ্রক সম্রাজ্ঞী আর ইয়াবার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে রিনা নামে এক মহিলা।
নগরীর ছোটপুল এলাকার ইয়াবার খুচরা বিক্রেতা পুলিশের তালিকাভুক্ত নারী ব্যবসায়ী পারভীন আক্তার। তার কাছ থেকে জানা গেছে, অভাবের সংসারে খরচ জোগাতে ভাই রেজাউল করিমের হাত ধরে তিনি এ ব্যবসায় আসেন। জানা যায়, পারভীন নগরীর শীর্ষ মাদক কারবারি রেজাউল করিম ওরফে ডাইল করিমের বোন। অন্য শীর্ষ নারী মাদক কারবারি ও স্পট নিয়ন্ত্রকের মধ্যে রয়েছে জুলেখা, সানজিদা, রোজিনা, আয়েশা, রাজিয়া, দেলোয়ারা, পারভীন, ফাতেমা, পাখি, রহিমা, বীথি, রেহানা, খাদিজা, বেবি প্রমুখ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর জোনের উপ–পরিচালক হুমায়ন কবির খন্দকার বলেন, মাদকের স্পটগুলোয় নারীদের সাধারণত সরাসরি খুচরা বিক্রির কাজে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আড়ালে থেকে মূলত মাদক কারবারিরাই মূল নিয়ন্ত্রণ করছেন। দারিদ্র্য, অসহায়ত্বসহ নানা সুযোগ নিয়ে নারীদের এ কাজে জড়ানো হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ক্রিমিনোলোজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, নারীদের নিয়ে একটা সহানুভূতি কাজ করে থাকে। মূলত এ কারণে নারীদের ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করেন মাদক কারবারিরা।