নগরীর বেশিরভাগ আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবনে নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা

অনেক এলাকায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ঢুকে না

জাহেদুল কবির | শনিবার , ২ মার্চ, ২০২৪ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

নগরীতে বেশিরভাগ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। অগ্নিনির্বাপণ আইনের তোয়াক্কা না করে নগরীতে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে শত শত আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। অগ্নিনির্বাপণ আইনে পরিষ্কার বলা আছেছয়তলার উপরে ভবনের ক্ষেত্রে তিন স্তরের নিজস্ব স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে প্রথম তলা থেকে তিন স্তরের এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখার বিধান রয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামের বেশিরভাগ আবাসিক ভবনেই তিন স্তরের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। নিজস্ব অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা দূরে থাক, অনেক এলাকার সড়ক এত সরু, কোনো ভবনে দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশেরও সুযোগ নেই। ফলে প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডে প্রচুর পরিমাণ সম্পদহানি হচ্ছে। এছাড়া প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। তবে বাণিজ্যিক ভবনের মধ্যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানসম্মত আবাসিক হোটেল ও দুয়েকটি শপিংমলে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রয়েছে। আবাসন নির্মাতারা জানান, বিদ্যমান অগ্নিনির্বাপণ আইন মেনেই তারা ভবন নির্মাণ করছেন।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত শীত মৌসুমে আগুন লাগার প্রবণতা খুবই বেশি থাকে। বিশেষ করে বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত সময়টিতে অগ্নি দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। কারণ এই সময়ে আবহাওয়া খুব শুষ্ক থাকে। ফলে দ্রুত ছড়িয়ে যায় আগুনের শিখা। তাই নগরবাসীকে এই ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, ফায়ার আইনে ছয় তলার উপরে আবাসিক ভবনের ক্ষেত্রে যদি ভবনের বাসিন্দা ৫০ থেকে ৫০০ জনের মধ্যে হয় তাহলে দুটি সিঁড়ি থাকতে হবে। এছাড়া বাসিন্দা ৫০০ থেকে এক হাজার জনের মধ্যে হলে তিনটি সিঁড়ি থাকতে হবে এবং এই সংখ্যা হাজারের বেশি হলে অবশ্যই চারটি সিঁড়ি রাখার বিধান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ছয় তলার উপরে প্রতিটি ফ্লোরের জন্য লিফট আকারের ফায়ার সেফটি লবি থাকার কথাও আইনে বলা আছে। এছাড়া আবাসিক ভবনের নিচে ১ লাখ গ্যালন (সাড়ে ৪ লাখ লিটার) এবং ভবনের ওপরে ৫০ হাজার গ্যালন (২ লাখ ২৫ হাজার লিটার) পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া আইনে অগ্নি নির্বাপনে তিন স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। প্রথম স্তরের মধ্য রয়েছে প্রত্যেক ৫৫০ বর্গফুটের জন্য একটি করে ফায়ার এক্সটিংগুইসার (অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র) রাখতে হবে। এটির ওজন ৫ কেজির কম নয় আবার ৮ কেজির বেশি নয়। দ্বিতীয় স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রয়েছে প্রতি ১০ হাজার বর্গফুটে একটি করে হোস রিলস (পানি চলাচলের পাইপ) এবং তৃতীয় স্তরে রয়েছে একটি হাইডেন কাম রাইজার, একটি ডিজেল চালিত পাম্প ও পানির চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য জোকি মেশিন থাকতে হবে। অধিকাংশ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের নিরাপত্তা বিধি মানা হলেও ব্যয় সংকোচনের জন্য মানা হচ্ছে না তৃতীয় স্তরের নিরাপত্তা বিধি। অথচ এটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

এদিকে নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজার, তামাকুমন্ডি লেন ও জহুর হকার্স মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, এসব মার্কেটের সড়কগুলো এত সরু ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপক গাড়ি প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া আগুন নেভানোর জন্য পানির কোনো উৎসও নেই। অথচ এসব মার্কেটে ইলেকট্রনিক্স, কাপড়, জুতা, কসমেটিকস এবং নানা ধরনের পণ্য সামগ্রীর প্রায় দুই হাজারের অধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অন্যদিকে বেশিরভাগ মার্কেটের দ্বিতীয় তলা থেকে উপরের দিকে গুদাম এবং কোনো কোনো ভবনের উপরের অংশ আবাসিক হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে। আবার দেখা যায়, মার্কেট ও ভবনগুলোর গা ছুঁয়েই বিদ্যুতের তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোনো কারণে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে এসব মার্কেটে আগুন লাগলে বিপুল পরিমাণ সম্পদহানির আশঙ্কা আছে। ভবন থেকে বের হতে না পেরে ধোঁয়ার কারণেও মৃত্যুর আশঙ্কা আছে।

ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, প্রত্যেকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখার কথা আইনে বলা হলেও অধিকাংশ ব্যবসায়ী সেই আইন মানেন না। অনেক প্রতিষ্ঠানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলে তা মেয়াদোত্তীর্ণ। এছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে ফায়ার লাইসেন্সও নেই। অগ্নিকাণ্ড রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে শপিং সেন্টারগুলোতে স্বয়ংসম্পূর্ণ অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকা, জরুরি প্রস্থানে সিঁড়ির সংখ্যা ও ছয়তলার উপরে প্রতি তলায় সেফটি লবির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে বৈদ্যুতিক তারে কনসিল ওয়্যারিং থাকা, বৈদ্যুতিক মেইন সুইচ বক্স ও ডিমান্ড বক্স নিরাপদ অবস্থানে থাকা এবং স্মোক ও হিট ডিটেক্টর এবং মার্কেটের ব্যবসায়ী ও কর্মীদের নিয়মিত অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ রাখার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা থাকলেও ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না। তবে নগরীর আন্তর্জাতিক মানের সবগুলো আবাসিক হোটেলে তিন স্তরের অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা রয়েছে। এ তালিকায় কিছু শপিংমলও যুক্ত হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহকারী পরিচালক এম ডি আবদুল মালেক দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর যেসব পুরনো ভবন রয়েছে সেগুলোতে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নেই। এছাড়া জলাধারের সংখ্যাও অত্যন্ত কম। তবে বর্তমানে যেসব বহুতল ভবন হচ্ছে সেগুলো অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছেঅনেক ক্ষেত্রে আবাসিক ভবনের অনুমোদন নিয়ে সেখানে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এক তলায় মার্কেট, এক তলায় রেস্টুরেন্ট কিংবা অপর তলায় লোকজন বসবাস করছে। অগ্নিদুর্ঘটনা হলে জরুরিভাবে বের হওয়ার কোনো সিঁড়িও নেই এসব ভবনে। বিষয়গুলোর দেখভালের জন্য আলাদা সংস্থা আছে, তবে আমরা প্রতিনিয়ত মানুষজনকে সতর্ক করছি। আমাদের সক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আমাদের কাছে বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতার মই রয়েছে। এটি দিয়ে ২৪ তলা পর্যন্ত অগ্নিদুর্ঘটনায় পানি ছিটানো যায়। এছাড়া ১০ তলা, ১৪ তলা পর্যন্ত কাজ করার মই আছে। অপরদিকে আমাদের বিশেষ পানির গাড়িও আছে। এতে ১১ হাজার লিটার পানি বহন করা হয়। আবার রিমোট কন্ট্রোলের একটি বিশেষ গাড়ি রয়েছে, যেটি দিয়ে আগুনের খুব কাছ থেকে পানি ছিটানো যায়। অপরদিকে রয়েছে, রাসায়নিকের আগুন নেভানোর বিশেষ গাড়ি। যেটিতে ফোম ও বিশেষ ফায়ার এক্সটিংগুইসার থাকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদক্ষিণ চট্টগ্রামে আনন্দ
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বে ১০০ কোটির বেশি মানুষ স্থূল : ডব্লিউএইচও