নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও কিছু কথা

হাবিবুল হক বিপ্লব | শনিবার , ৩০ নভেম্বর, ২০২৪ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বব্যাপী আজ নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। নগরী সমাজ ব্যবস্থার শীর্ষে। যতই দিন যাচ্ছে মানুষ উন্নত চিন্তা চেতনায় সমৃদ্ধ হচ্ছে, আর নগরে ভিড় করছে। কারণ নগরের সার্বিক ব্যবস্থাপনা। উন্নত দেশগুলোতে নগরীকে গড়ে তোলা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায়। যারা অপরিকল্পিত নগরী গড়ছে তারা পিছিয়ে পড়ছে, এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে নগর হচ্ছে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। কর্মসংস্থান, ব্যবসাবাণিজ্য সবকিছু নগরকেন্দ্রিক। তাই নগরকে বাসযোগ্য রাখার সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি। তথ্য থেকে পাওয়া যায় ১৯৫০ সালে মানব বসতির মাত্র ৩০ ভাগ ছিল নগরে। ১৯৯৫ সালে এ হার বেড়ে হয়েছে ৪৫ ভাগ। এমন হারে বাড়তে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীর ৭০ ভাগ মানুষ নগরে বাস করবে এমন ধারণা বিশেষজ্ঞদের। আর হয়ত এ কারণেই অতি দ্রুত নগরের বিস্তৃতি ঘটছে। তাই নগর মানুষের পদভারে ক্লান্ত। নগরবাসীকে সচল রাখার অন্যতম কাজ হল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এ থেকে পিছিয়ে থাকার উপায় নেই। কারণ বর্জ্য পচনশীল, দুর্গন্ধময়, রোগজীবাণুসম্বলিত, আবার রোগজীবাণু জন্মও দেয়। জনপ্রতিনিধিরা এ বিষয়ে যত বেশি তৎপর হবে, নগরীর জনগণ হবে ততটা নিরাপদ। তবেই শিশুরা বড় হবে উন্নত চিন্তাচেতনায়, সমৃদ্ধ হবে তাদের জীবন, বেড়ে উঠবে সুস্থসবলভাবে। পয়ঃমলের মত আরো ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য হচ্ছে কলকারখানার কেমিক্যাল বর্জ্য। এই বর্জ্যও উন্মুক্ত স্থানে বা ডোবায় ফেলা উচিত নয়। কারণ এই বর্জ্য বিষাক্ত, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এর সংস্পর্শে এলে মানুষ রোগাক্রান্ত হয়। তাকে মাটির গর্তে ফেলে পরিশোধন প্রয়োজন। নগরীতে কম ঝুঁকিপূর্ণ অথচ উল্লেখযোগ্য বর্জ্য হচ্ছে গার্বেজ। যা কাগজ, কাপড়, লতাপাতা, তরকারির খোসা থেকে উৎপন্ন। নগরীতে এই বর্জ্যের পরিমাণ বেশি। তথ্য থেকে পাওয়া যায় এই বজ্যের্র মাথাপিছু পরিমাণ দৈনিক ১৫.২৫ কিলোগ্রাম। এই বর্জ্য যাতে বসবাসকারীদের সুবিধামত নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা হয় সেই ব্যবস্থা প্রয়োজন। প্রয়োজন প্রতি রাতে দ্রুত সরিয়ে নেয়া। এই কাজটির জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রাক, ট্রলি ও দক্ষ জনবল দরকার। এই বর্জ্য ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে পরিশোধন হবে অন্যতম কাজ। যে নগরীতে উঁচু ঘের দেয়া ডাম্পিং স্টেশন আছে এগুলো সচল রাখা এবং যেখানে ডাম্পিং স্টেশন নেই সেখানে নির্মাণ দরকার।

ডাম্পিং স্টেশনটি হবে শহরের বেশ দূরে পূর্ব ও পশ্চিমে অথবা একটি স্থানে। ডাম্পিং স্টেশনে কঠিন, অপচনশীল দ্রব্যসামগ্রী আলাদা করে নেয়া উত্তম। এই বর্জ্যকে কখনো হাসপাতাল বর্জ্য বা কলকারখানায় বর্জ্যের সাথে মিলানো উচিত নয়। ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যকে আলাদা সংগ্রহের জন্য নগরীতে পাশাপাশি আলাদা ডাস্টবিন স্থাপন করা যেতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য পরিশোধনের জন্য নির্মাণ করতে হবে আলাদা ডাম্পিং স্টেশন। আর প্লাস্টিক সামগ্রীর মত সে সকল বর্জ্য রিসাইক্লিং করা সম্ভব তাকে আলাদা রাখা উত্তম। গার্বেজ বর্জ্য যেহেতু কম ঝুঁকিপূর্ণ এগুলো নিয়ে প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা। তৈরি করা প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত ডাম্পিং স্টেশন। যাতে গার্বেজ বর্জ্য সহজে পচবে, সার হবে। পুড়িয়ে ছাই ও সার উৎপন্ন করার লক্ষ্যে ডাম্পিং স্টেশন চিমনিযুক্তও হতে পারে। গার্বেজ বর্জ্য থেকে প্রাপ্ত কম্পোস্ট সার চাষাবাদের কাজে ব্যবহার করে অধিক ফসল উৎপাদন সম্ভব। লক্ষ্য করা যায় অনেক কর্তৃপক্ষ এ জাতীয় ময়লা রাস্তার পাশে ফেলছে, ভূমি উন্নয়নের উদ্দেশ্যে। এটি একটি গর্হিত কাজ। এতে ময়লা আবর্জনা পচে পরিবেশকে অস্বাস্থ্যকর করে তুলছে। পানিকে করছে দূষিত ও ব্যবহার অনুপযোগী। নগরবাসীকে বাঁচিয়ে রাখতে গড়ে তুলতে হবে ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক। নিতে হবে মাস্টার ড্রেন স্যুয়ারেজ লাইনের মধ্যে জমে থাকা কঠিন বর্জ্য অপসারণের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এর জন্য প্রয়োজন সার্বক্ষণিক দক্ষ জনবল।

তাদের স্বাস্থ্য সচেতন করতে প্রয়োজন হবে অব্যাহত প্রশিক্ষণ। সুস্থসবল লোকদের দ্বারাই এই কাজটি প্রতিদিন করা সম্ভব। তা না হলে নগরী হবে বর্জ্যে একাকার, লাইনগুলো হবে ময়লায় ভর্তি, বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা হবে ব্যাহত। খানিক বৃষ্টি হলেই নগরী হবে জলাবদ্ধ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সাথে আরো একটি জরুরি কাজ নগরবাসীর চিন্তাচেতনাকে সমৃদ্ধ করা। তাদের যোগ্যতা বৃদ্ধি করা, সচেতন করা। একটি প্রবাদবাক্য হচ্ছে: ‘আগে যোগ্য হও, পরে কামনা কর’। যোগ্যতা অর্জন ব্যতীত উন্নত ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে চলা সম্ভব নয়, টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। নগরবাসী যেন কাগজ, ফলমূলের খোসা, অপ্রয়োজনীয় জিনিস যত্রতত্র না ফেলে। রাস্তাঘাট অপরিচ্ছন্ন না করে এই সচেতনতা বৃদ্ধি সর্বাগ্রে প্রয়োজন। তবেই উন্নত ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সাথে জনগণকে এই ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করার জন্য সমৃদ্ধ করা জরুরি। এই কার্যক্রমে নারীপুরুষের জন্য নিতে হবে সমান উদ্যোগ। তবেই উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন সহজ হবে, সার্থক হবে। নগরী হবে দৃষ্টিনন্দন, স্বাচ্ছন্দ্যময়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধগ্রামবাংলার হেমন্ত
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে