প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্ক চিরকালীন। মানুষ চায় প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে। তার কাছে যেতে মন সবসময় উচাটন থাকে। ফলে এই শহরের শ্বাস ফেলার এক টুকরো সবুজ খণ্ড ‘সিআরবিতে’ মানুষ প্রতিদিন ভিড় করে। কখনো একা, কখনো ছেলে বা কখনো মেয়েকে নিয়ে হাঁটতে বেরোয় এখানে। প্রকৃতির অকৃপণভাবে ঢেলে সাজানো সৌন্দর্য মানুষকে চুম্বকীয় কায়দায় কাছে টানে। প্রশস্ত পথ আর সবুজ বৃক্ষরাজি মন আর শরীরকে স্নিগ্ধ করে।
সেই সবুজ প্রকৃতি এখন রুদ্ধ। এখানে এখন হাঁটা যায় না। বসা যায় না। শ্বাস নেওয়া যায় না। মেলা এসে দখল করে নিলো কাঙ্ক্ষিত সবুজ খণ্ড। দৈনিক আজাদীতে গত ৮ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ‘এবার মেলার দখলে সিআরবি, শিরীষতলায় টিনের ঘেরা দিয়ে মাঠজুড়ে স্টল, পরিবেশ প্রতিবেশের ক্ষতির শঙ্কা’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত নগরীর সিআরবির মতো সংরক্ষিত এলাকায় এবার মাসব্যাপী শুরু হচ্ছে বাণিজ্যিক মেলার আদলে জামদানি মেলা। সিআরবির শিরীষতলার পুরো মাঠ টিনের ঘেরাও দিয়ে মাঠের ভেতরে ছোট–বড় অনেকগুলো স্টল নির্মাণ করা হয়েছে। মাঠে বিছানো হয়েছে ইট। উপরে দেয়া হয়েছে ত্রিপল। মাসব্যাপী দেশীয় পণ্য ও জামদানি মেলার নামে এ আয়োজন আজ থেকে শুরু হচ্ছে। সিআরবি শিরীষতলায় গিয়ে একাধিক স্টল মালিক এবং মেলা আয়োজনের সাথে জড়িতদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। মেলার জন্য টিনের ঘেরা দিয়ে মাঠ জুড়ে স্টল, মাসব্যাপী উচ্চস্বরে মাইকে পণ্যের পাবলিসিটিতে পরিবেশ প্রতিবেশের ক্ষতির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতি কর্মী ও পরিবেশবিদরা।
এ বিষয়ে সিআরবির মাঠে মেলার আয়োজনের অনুমতি দেয়া ও ভাড়ার ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে এই প্রতিবেদনে। তিনি বলেছেন অন্য কথা। বললেন, ‘সিআরবিতে জামদানি মেলা করার জন্য ঢাকা থেকে একজন লোক এসেছিলেন। আমাদের কাছে আবেদন করেছেন। আমি ১৫ দিনের অনুমতি দিয়েছি। তবে কোনো ভাড়ার বিনিময়ে নয়। আমরা সিআরবি মাঠ ব্যবহারের জন্য এখনো পর্যন্ত ভাড়া নিইনি কারো কাছ থেকে। এখন আমরা ভাড়া নির্ধারণ করবো। ওই ব্যক্তি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জামদানি শাড়ি দেয়ার বেশ কিছু ছবি আমাকে দেখিয়েছেন। এজন্য আমি তাকে মাঠ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছি। দেশীয় জামদানি শাড়ির প্রসারের ব্যাপারে। এখন মেলায় প্রতিটি স্টল থেকে এতো টাকা ভাড়া নিচ্ছে সেটা আমি জানতাম না। বিষয়টি আমি দেখবো।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাহাড় ঘেরা ও সবুজের সমারোহে ঘেরা চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অপরূপ। ইদানীং খেলার মাঠ, জলাধার, বনভূমি প্রভৃতি দখল, ভরাট, দূষণের পরও যে কয়েকটি স্থান এখনও এই সৌন্দর্য ধরে আছে সিআরবি তার মধ্যে অন্যতম। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি চর্চা, মুক্ত প্রাণে শ্বাস নেওয়ার জন্য সিআরবি এখানকার সকলের কাছে পরম পরিতৃপ্তির স্থান। এখানকার একটা গাছের পাতাও সেই অর্থে অনেক গুরুত্ব বহন করে। গাছগুলো ইতিহাসেরও সাক্ষী, অতএব এখানে মানুষের আবেগ জড়িত। কোনো অবস্থাতেই এ পরিবেশ নষ্ট করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সব ধরনের বৃক্ষবৈচিত্র্য সুরক্ষা করে এখানকার মানুষের শ্বাস ফেলার জায়গাটুকু দখল থেকে রক্ষা করতে হবে। পরিবেশ নিরাপদ থাকলেই আমাদের অঙিজেনের মজুদ হবে পর্যাপ্ত ও সুরক্ষিত।
তবে এটাও সত্যি যে খেলা যেমন মানুষের পছন্দের মাধ্যম, তেমনি মেলাও। খেলা যেমন স্বাস্থ্যের জন্য বড় গুরুত্বপূর্ণ, মেলা তেমন বিনোদনের জন্য। খেলা মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটায়। এ জন্য মাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। খেলা বন্ধ করলে শিশু ও যুবকদের শারীরিক বিকাশে আঘাত আসে। তেমনি মেলা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। এটি বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। এজন্য খেলার মাঠের প্রতিবন্ধতা যেমন প্রত্যাশিত নয়, তেমনি মেলার জন্যও নির্ধারিত স্থান থাকা দরকার।
নগরবাসীর যান্ত্রিক জীবন পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে সুস্থ দেহে বেঁচে থাকাটা আজ দুরূহ ব্যাপার। এ অবস্থায় সাধারণ জনগণ একটু অবসর পেলেই সিআরবি এলাকায় নির্মল বায়ুতে নিশ্বাস নিতে হাজির হয়। মানুষ শিরীষ তলার ছায়াতলে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে সতেজ করে ফুসফুস। তাই এ ফুসফুসের ক্ষতি কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না।