নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে সয়লাব দেশের ওষুধের বাজার। দেশে যেমন নকল হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, তেমনি নষ্ট ওষুধ বিক্রি করে মানুষের জীবনকে শঙ্কার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্যানসার, লিভার, হৃদরোগ, কিডনিসহ প্রায় সব রোগের নকল ওষুধে বাজার সয়লাব। বাদ যাচ্ছে না আইসিইউ, সিসিইউয়ের ওষুধ সরঞ্জামও। একে গণহত্যার শামিল হিসেবে আখ্যায়িত করে বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, মানুষ অসুস্থ হয়ে ওষুধ সেবন করে। আর নকল ওষুধ সেবন করে মানুষ সুস্থ না হয়ে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে। মহামারিতে যে পরিমাণ মানুষ মারা যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ খেয়ে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো আইসিইউ ও সিসিইউতে চিকিৎসাধীন যে সব রোগীদের নকল ও ভেজাল ওষুধ দেওয়া হয় তাদের মৃত্যু শতভাগ নিশ্চিত বলে বিশেষজ্ঞরা জানান। তাঁরা বলেন, ‘ওষুধ অতিপ্রয়োজনীয় একটি পণ্য। কারণ, এটি জীবন রক্ষাকারী। অত্যন্ত স্পর্শকাতর পণ্য হওয়ায় ওষুধের মান ঠিক না থাকলে রোগীর সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। মূলত সঠিক মানের ওষুধের ওপর নির্ভর করে রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠা। কিন্তু দেশে মানবহির্ভূত ওষুধ বাজারে বেচাকেনা হচ্ছে প্রায় বাধাহীনভাবে। অথচ যাদের এটি নজরদারি করার কথা, তারা সেটা করছে না। ওষুধ আসল না নকল, তা যাচাই করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের থাকার কথা নয়। আর ওষুধ যদি জীবন রক্ষার পরিবর্তে জীবন হরণের কারণ হয়, তাহলে তা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।’
যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া টেম্পল ইউনিভার্সিটির মেডিসিন ও কিডনি বিভাগের অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন আহমদ তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ‘একটি নয়, অনেক পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ অনেক দিন ব্যবহার করলে কোনো ক্ষতি হয় না। সবচেয়ে বড় গবেষণা করেছে এফডিএ। তারা মার্কিন মিলিটারিদের তিন বিলিয়ন ডলার মূল্যের ১০০ শ ওষুধ পরীক্ষা করে দেখেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ১৫ বছর পরও ৯০ শতাংশ ওষুধ কার্যকর ও নিরাপদ রয়েছে। তবে কিছু ওষুধ, যেমন ইনসুলিন, নাইট্রোগ্লিসারিন এবং তরল বা লিকুইড অ্যান্টিবায়োটিক মেয়াদোত্তীর্ণ হলে কাজ না–ও করতে পারে। দুঃখের বিষয়, এত কিছু জানার পরও কিন্তু সেটা সাধারণ জনগণ, ফার্মেসি ও হাসপাতালের জন্য প্রযোজ্য নয়। সরকারি ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যের সংস্থা আইন করে ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখা বেআইনি ঘোষণা করেছে। তা ছাড়া সব হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জয়েন্ট কমিশন সব মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ হাসপাতালে রাখলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করার জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ২০০০ সালে বিবৃতিতে এ আইনকে পরিবর্তন করে ওষুধের মেয়াদ আরও ন্যায়সংগতভাবে বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছে, যাতে ওষুধের মূল্য কমানো যায়, স্বাস্থ্য খাতের অনেক অপচয় কমে এবং মানুষ সহজে জরুরি ওষুধ সময়মতো পেতে পারে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের লোভ ও রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিক নীতি বারবার এ উদ্যোগকে আটকে দিয়েছে। তাই বাংলাদেশসহ সব দেশেই এ অপচয় বন্ধ করার জন্য একটি সাহসী ও মানবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার হয়ে পড়েছে।’ কিভাবে সেটি করা যাবে, তা সরকার ও বিশেষজ্ঞরা চিন্তা করবেন। নিজেদের সচেতনতা বাড়ালে ভয়ভীতি ও অপচয় কম হবে। তা ছাড়া আমাদের সাধারণ মানুষ আর গ্রামগঞ্জের ফার্মেসিতে ভেজাল বা নকল ওষুধ না কিনে যদি ভালো কোম্পানির মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কিনতে পারে, তাহলে অনেক গরিব মানুষ বেঁচে যাবে। আর অপমান ও বেআইনি হওয়ার প্রয়োজন হবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ড্রাগস আইনে নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে ১০ বছর। তবে জরিমানার অঙ্ক নির্দিষ্ট না থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয় না। বিশেষ ক্ষমতা আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু মামলা হওয়ার পর তদন্তের ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ফেলে নকল ওষুধ উৎপাদনকারীরা। এ কারণে বন্ধ হচ্ছে না নকল ওষুধ উৎপাদন। নকল ওষুধ উৎপাদন, বিক্রি ও বিপণনে যারা জড়িত তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দাবি রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের মতে, এক জন খুনি এক জন মানুষকে হত্যা করে। আর নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারীরা নীরবে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। তাদের কোনো ক্ষমা নেই। নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ, নষ্ট ও ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। তাদের মনিটরিং ব্যবস্থা আরো কার্যকর হতে হবে।