ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস ও অধ্যবসায় শিক্ষার্থীর জন্য জরুরি

সুপ্রতিম বড়ুয়া | মঙ্গলবার , ১৮ মার্চ, ২০২৫ at ৪:৩৪ পূর্বাহ্ণ

ধৈর্য ধরে কঠিন অধ্যবসায় করলে যে কোনো খারাপ ছাত্রই কালক্রমে পরিণত হতে পারে আকাঙ্ক্ষিত ভালো ছাত্র হিসেবে। ছাত্রজীবনে সবার আগে অর্জন করতে হবে পবিত্রতা, ধৈর্য ও অধ্যবসায়। পবিত্রতার অর্থ সব রকমের মলিনতা থেকে মুক্তি। চঞ্চলতা, ঈর্ষা, আলস্য ও তীব্র আসক্তি দূর করলে তবেই মন পবিত্র হয়। চঞ্চলতা মানে একাগ্রতার অভাব। কোনো কিছুই সিরিয়াসভাবে না নেওয়া চঞ্চলতার লক্ষণ। ঈর্ষার কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা সবাই কম বেশি ঈর্ষাপরায়ণ এবং কম বেশি অন্যের ঈর্ষার শিকার। ঈর্ষা থেকেই আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটে। একজন শিক্ষার্থী কয়েকটি পরীক্ষায় লেটার পেয়েছে, কারণ ওর বাবার টাকা আছে। গাদা গাদা প্রাইভেট টিউটর রেখেছেকোচিং করেছে। সুতরাং পরীক্ষায় সে ভালো করতেই পারেএই ধরনের চিন্তাই ঈর্ষা। আর এক কথা যত আমি ভাববো ততই আমার কাজেকর্মে উৎসাহ কমতে থাকবে। কারণ ঈর্ষাপরায়ণ হওয়া মানেই নিজেই আগে ভাগে পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া। ঈর্ষাকে জয় করতে গেলে সমস্ত মনোযোগ অন্যের দিকে না দিয়ে নিজের দিকে দিতে হবে। আমরা ইংরেজদের ঈর্ষা করি। ওরা শোষণকারী সাম্রাজ্যবাদী কতকিছু বলে ওদেরকে গালি দিই। আবার ঈর্ষাকাতর হয়ে ওদের মত হবার জন্য ওদের সাজপোশাক, সমাজ ব্যবস্থার নকল করি। ভাবি অনুকরণ করে সাহেব হলেই ওদের সমকক্ষ হবো। কিন্তু ওদের চরিত্রের নানা ইতিবাচক দিকগুলি কখনও গ্রহণ করার চেষ্টা করি না।

সঠিকভাবে ভালো ছাত্র বা ছাত্রী হতে হলে তাকে অধ্যবসায়ী হতে হবে। ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সফলতা একবারে আসে না। ভালো কোনো কাজ করতে গেলে বার বার কাউকে হোঁচট খেতে হতে পারে। প্রকৃত অধ্যবসায়ের অর্থ হলো কোনো কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে কখনও কখনও মানুষকে বিফলও হতে হয়। এই বিফলতাকে অগ্রাহ্য করে সফলতার আশায় আবার সেই কাজে নিজেকে নিয়োজিত করার নামই অধ্যবসায়। নিজের ভেতর প্রবল ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষার সাথে সাথে দৃঢ় মানসিক শক্তি বা মনের প্রকৃত গতি সঞ্চয় করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই আসল অধ্যাবসায়ীর লক্ষণ। অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের জীবনী থেকে আমরা জেনেছি ‘অসফলতা হচ্ছে সফলতার স্তম্ভস্বরূপ’। সুতরাং একবার অসফল হলেই যে বারবার তাই ঘটবে তা কিন্তু মোটেই নয়। বরং যদি প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে বারবার চেষ্টা করা হয়, তাহলে একদিন না একদিন সফল হবেই।

শিক্ষার্থীদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, কোনো মানুষই রাতারাতি সফল হতে পারে না। প্রকৃত অর্থে সফল হতে হলে তাকে স্বীকার করতে হয় নানা ত্যাগ আর শ্রম। কেউ যদি একবার পরীক্ষায় ফেল করে মনে করে তার দ্বারা আর ভালো ফল আশা করা বৃথা। তাহলে বলবো সে সত্যিকার অর্থেই অসফল ব্যক্তি। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, যে কোনো মানুষ যদি উদ্যম না হারিয়ে বারবার মানসিক শক্তি দিয়ে গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সাথে কাজ করে যায় তাহলে সফলতা সে অর্জন করবেই করবে। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা এমন অনেক অসফল ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাই যারা একবার অসফল হয়েই সবকিছু বিসর্জন দেননি। বরং বারবার চেষ্টা করে চূড়ান্ত পরিণতিতে সফল হতে পেরেছেন। রবার্ট ব্রুশ ইংল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন পরপর ছয়বার। এই ছয়বারই তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। লোকবল, অর্থবল অনেক কিছুই তিনি হারিয়েছেন এই ছয়বারের যুদ্ধে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন নি। কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেও যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন। সাতবারের বেলায় ঠিকই তিনি জয়ী হয়েছিলেন। মোঘল সম্রাট বাবর একবার এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হতোদ্যম অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এক গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেইসময় তিনি দেখেছিলেন একটি পিঁপড়া গুহার পাথুরে দেয়াল বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। কৌতূহলী বাবর লক্ষ্য করলেন, পিঁপড়াটি ঊনষাটবার উঠতে গিয়ে অকৃতকার্য হলো এবং ষাটবারের বেলায় ঠিকই উঠতে পারল। দৃশ্যটি বাবরের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করল। তিনি ভাবলেন, একটি ক্ষুদ্র প্রাণী পিঁপড়া যদি ঊনষাটবার অকৃতকার্য হবার মতো শক্তি রেখে পরবর্তীতে ষাটবারের মতো শক্তি সঞ্চয় করতে পারে তাহলে আমি কেন পারব না। সত্যি কথা বলতে কী এই দৃশ্য দেখেই সম্রাট বাবরের মনে প্রবল উদ্দীপনা জাগ্রত হল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আবার যুদ্ধে যোগদান করলেন। এবার তাঁর জয় ঠিকই হলো।

গিরিশির হতে যখন পাহাড় খণ্ড নামতে থাকে, তখন তাকে প্রথমটা দেখে মনে হয় এই নগণ্য পাহাড়ের টুকরোটা কিছুই নয়। ক্রমে যখন সে নিচে নেমে আসে, তখন তার শক্তি হয় অতি ভয়ানক। সম্মুখে যা কিছু পায় ভেঙে চূর্ণ করে নিয়ে যায়। আমার বাড়ির সামনে একটি পানের দোকান আছে। আমার ঘরের জানালা দিয়ে সেই দোকানটি দেখা যায়। আমি রোজই দেখি একটি লোক সামান্য একটু জায়গার মধ্যে পা মুড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন বসে পান বিক্রি করছে। পৃথিবীতে কত কী ঘটে যাচ্ছে। তারই চারপাশে এ শহরে হাজার হাজার মানুষ সিনেমা থিয়েটারে যাচ্ছে, নানা ধরনের প্রমোদখানা থেকে বেরুচ্ছে। খেলা দেখে ফিরছে, বাড়ি গিয়ে তারা চা থেতে খেতে টিভির সামনে বসবে। কিন্তু এই পানওয়ালা হাঁটু মুড়ে বসে তেমনি রাত বারোটা পর্যন্ত এভাবে পান সেজে যাবে। ‘খদ্দের এলো তো এলো। না এলো তো না এলো। ধৈর্য ও নিষ্ঠা কী আমরা এদের কাছ থেকে শিখতে পারি না?

ধৈর্য ও অধ্যবসায় ছাড়া কোনো কিছু লাভ করা যায় না। একটা সাধারণ বাড়িও দেড় বছরের আগে হয় না। তাজমহল গড়তে ২২ বছর লেগেছিল। একজন মহাপুরুষের আগমনের জন্য কত প্রজন্ম অপেক্ষা করতে হয়। ধৈর্য ধরলে ফল পাওয়ার শতকরা ৭৫ ভাগ আশা থাকে। তবে সেই ধৈর্যের সাথে যুক্ত করতে হয় আত্মবিশ্বাসের সাথে পথ চলা। শুধু আত্মবিশ্বাস থাকলে যেমন কাজ হবে না। তেমনি শুধু ধৈর্য ধরে ঘরে বসে থাকলেও কাজ হবে না। কোনো কাজের মধ্যে ধৈর্য না ধরলে পাওয়ার আশা শূন্য। ছিপ ফেলে বসে থাকলে মাছ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ছিপ না ফেললে মাছ পাবার আশা করবো কী করে? ধৈর্য আশার সন্তান। আশাবাদী না হলে বিশ্বাসী ধৈর্য ধরা যায় না। আর একমাত্র আত্মবিশ্বাসী ছাড়া আশাবাদী হওয়া যায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, অধ্যক্ষ, রামু সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজেগে ওঠো
পরবর্তী নিবন্ধআইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিন