সমগ্র চট্টগ্রামে ধূলি দূষণের মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ধূলি দূষণে পর্যুদস্ত হচ্ছে নগরবাসী। দুর্ভোগের শিকার নগরের মানুষ। বাড়ছে দুর্গতি সকল শ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষের। ধূলিকণার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধিতে মাস্কছাড়া চলাফেরা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। গত ১৭ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে ‘শহরের অলিগলি থেকে রাজপথ ধুলোর দখলে, নানা রোগে আক্রান্ত মানুষ, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘নগরীর বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ধুলোবালির পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। সড়কজুড়ে থাকা খানাখন্দের কারণেও ধুলো বাড়ছে। পাহাড় কাটা, নালা নর্দমা ভরে ওঠা, উন্মুক্ত ময়লার ভাগাড়সহ নানা কারণে ধুলোময় হয়ে উঠেছে শহর। এদিকে ধুলোবালি পরিষ্কার কার্যক্রম ঠিকভাবে না হওয়া এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বিশেষায়িত গাড়িগুলোর কার্যক্রম না লাগায় ধুলো বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, চট্টগ্রাম মহানগরীর বাতাসের মানদণ্ড পরিমাপ করার যে সূচক তাতে নগরীর অবস্থা নাজুক। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেঙ বা একিউআই সর্বোচ্চ ৫০ পর্যন্ত হলে ওই বাতাসকে ভালো বলা হয়। শূন্য থেকে এই পরিমাপ করা হয়। কিন্তু গত সোমবার নগরীর বাতাসে একিউআই ১৬০ পাওয়া গেছে, যা অস্বাস্থ্যকরের শেষ ধাপের দিকে রয়েছে। একিউআই স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হওয়ার অর্থ হচ্ছে নগরীর প্রত্যেক বাসিন্দার ওপর অস্বাস্থ্যকর বাতাসের প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও নানা রোগে আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায়। একিউআই ২০১ থেকে ৩০০ হলে স্বাস্থ্য সতর্কতার ব্যাপারে অনেকটা জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়। যাতে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ রোগীদের ঘরের বাইরে যেতে এবং অন্যদের ঘরের বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। রাতে বাতাসের একিউআই স্বাভাবিকভাবে কমে আসে। কিন্তু নগরীতে রাতেও একিউআই পাওয়া গেছে ৮০, যা স্বাভাবিকভাবে নগরীর খারাপ পরিস্থিতিরই প্রমাণ দেয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীতে এমন অনেক উপাদান ও পদ্ধতি বিদ্যমান, যেগুলোর সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ায় নগরীর আবহাওয়া ক্রমশ দূষিত হচ্ছে। যে সব উপাদান বা পদ্ধতি পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সংকীর্ণ সড়ক, যানজট, মোটরযানে নিম্নমানের অথবা মবিলমিশ্রিত জ্বালানি ব্যবহার, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পুরনো মোটরযানের অবাধ চলাচল, ঠাসাঠাসি যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা, খোলা ট্রাকে মাটি বালি–আবর্জনা–কয়লা বা সিমেন্ট পরিবহন, পুরনো লক্কড় ঝক্করমার্কা শিল্প কারখানা, শহরের আশেপাশে ইটের ভাটা, খোলা জায়গায় বর্জ্য–আবর্জনা পড়ে থাকা প্রভৃতি। এছাড়া আরও কিছু উপাদান নগরীর বাতাসকে ভারি করে। যেমন : আবর্জনা পোড়ানোর ধোঁয়া, সময়মতো বর্জ্য অপসারণ না করা, অব্যবস্থাপনার কারণে কঠিন বর্জ্য ফেলার স্থাপনাগুলোতে আবর্জনা খোলা অবস্থায় পচতে থাকা, অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং তা থেকে ধুলো ময়লা কাদা সৃষ্টি, খোলা জায়গায় নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখা, খোলা পয়ঃপ্রণালী ও নর্দমা, খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ, কাঁচা বাজারের পচনশীল বর্জ্য এবং উন্মুক্ত জায়গায় গরু–ছাগল জবাই–তার থেকে রক্ত যত্রতত্র ছিটিয়ে পড়া। দূষণের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। দূষণ জনিত মৃত্যুতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বায়ু দূষণের, যা মোট মৃত্যুর প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ। এক তথ্যে জানা যায়, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ এখন বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। বায়ু দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব অনেক। দূষিত বায়ুতে আমাদের নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হয়। বায়ু দূষণের ফলে সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা ও সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর। দূষিত বায়ু আমাদের শরীরে নানা রকম রোগ সৃষ্টি করে থাকে। বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। তাই ধূলাবালি থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বায়ুদূষণ রোধ করার জন্যে এখনই সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে। যানবাহন থেকে দূষণ এবং কালো ধোঁয়া নির্গমন রোধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর খোঁড়াখুঁড়ি কাজের সমন্বয় সাধন করা ও বায়ু দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করতে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মোট কথা, দূষণরোধ করার জন্যে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।