পটিয়ায় নির্মাণকাজ শেষের আগেই ধসে পড়ল ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কালারপোল সেতু। এতে দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণাধীন এ সেতু চলাচল উপযোগী করতে আরো অনেক সময় লাগবে। কয়েক দফা মেয়াদও বাড়ানো হয়। এরপরও নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই গতকাল শুক্রবার রাত ৮টার দিকে কালারপোল সেতুর তিনটি গার্ডার ধসে পড়ে। এ ঘটনায় নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ৩ শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছে। সেতুটি ধসে পড়ার পেছনে ঠিকাদারের নিম্নমানের কাজকে দায়ী করেছেন এলাকাবাসী। স্থানীয়দের অভিযোগ, একটি সেতুর জন্য ১৩ বছর ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কয়েক লাখ মানুষকে। তবে সওজের দাবি, সেতু নির্মাণে কোন অনিয়ম বা গাফেলতি হয়নি।
দোহাজারী সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ জানান, ‘হাইড্রোলিক জ্যাকের ( ক্রেন) মাধ্যমে গার্ডার বসানোর সময় জ্যাকের পাইপ ফেটে যাওয়ায় সেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, ফলে গার্ডার পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার সময় একটি গার্ডারের ধাক্কায় অপর দুইটি গার্ডারও ধসে পড়ে। তিনি বলেন, একটি গার্ডার থেকে আরেকটি গার্ডারের দূরত্ব দুই মিটার। যে কারণে একটির ধাক্কায় আরেকটি, এভাবে তিনটি গার্ডার পড়ে যায়। কাজে কোনো অনিয়ম হয়নি। এতে ঠিকাদারের ৭৫ লাখ টাকার ক্ষতি হবে। তবে ঠিকাদার নিজ অর্থেই ধসে পড়া তিনটি গার্ডার নতুনভাবে করে দেবে।
তিনি বলেন, সেতুটির প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। হঠাৎ করে একটি দুর্ঘটনায় সেতুটি ধসে পড়েছে।একটি গার্ডারের ওজন ৩৫ টন।
কালারপোল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মুহাম্মদ সোলায়মান জানান, কালারপোল সেতুর গার্ডার ধসের ঘটনায় কতজন শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছে তা এ মুহূর্তে সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে দুইজন আহত শ্রমিককে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, সেতুটির তিনটি গার্ডার ধসে নদীর পানিতে ডুবে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা আলমগীর জানান, রাত ৮ টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দ হয়। পরে আমরা গিয়ে দেখতে পায় গার্ডার ভেঙ্গে নদীর তলদেশে চলে যায়। ঠিকাদারের নিম্নমানের কাজের কারণে সেতুটি ধসে পড়েছে। এতে সেতু নির্মাণ কাজের ৩ শ্রমিকও নিখোঁজ রয়েছে। তিনি আরো বলেন, একটি সেতুর জন্য ১৩ বছর ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কয়েক লাখ মানুষকে। তিন দফা মেয়াদ বাড়ানোর পরও পটিয়ার কালারপোল সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই ধসে পড়ার ঘটনা খুবই মর্মান্তিক।
দোহাজারী সড়ক ও জনপথ সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের ১৮ নভেম্বর সেতুটি ভেঙে যাওয়ার পর নতুনভাবে সেতু নির্মাণের জন্য প্রথমবার ২২ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় সেতু মন্ত্রণালয়। সংশ্নিষ্ট ঠিকাদার কিছুদিন কাজ করে। এরপর কাজ বন্ধ করে চলে যায়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বার ২০১৭ সালে সেতুর জন্য ২৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা নতুনভাবে বরাদ্দ দেয় মন্ত্রণালয়।
২০১৪ সালের ৮ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর নামে সেতুটির নামকরণ হয়। এটির নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কালারপোল সেতু ১৯৯৫ সালে নির্মিত হয়। ২০০৭ সালের ১৮ নভেম্বর একটি কারখানার টিনের কয়েল বোঝাই বার্জের আঘাতে সেতুর ৩য় ও ৪র্থ স্প্যান নদীতে নিমজ্জিত হয়। সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন হওয়ার পর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পুরনো স্প্যানটির ওপর সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য একটি বেইলি ব্রিজ তৈরি করে দেয়। দ্বিতীয় দফায়ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বছর দুয়েক সেতুর কাজ করার পর লোকসান দেখিয়ে কাজ ফেলে চলে যায়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় মেয়াদে ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সেতু মন্ত্রণালয়। দেড় বছর আগে নতুনভাবে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে আরেকটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘসময় ধরে ধীরগতিতে চলে কালারপুল সেতুর নির্মাণকাজ। এ পর্যন্ত পাঁচটি পিলারের কাজ শেষ হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, খাল পারাপারে সেতুটি একমাত্র ভরসা হওয়ায় ওই পথে যাতায়াতে ভোগান্তিতে রয়েছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। কালারপোল লাখেরা উচ্চ বিদ্যালয়, কালারপোল হাজি ওমরা মিয়া চৌধুরী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, কালারপোল অহিদিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, এ জে চৌধুরী স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়া করে। এছাড়া সেতুর উভয় পাশে গড়ে ওঠেছে কয়েকটি শিল্প-কারখানা, লবণ কারখানা, শতাধিক পোলট্রি ও ডেইরি ফার্ম। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের খাল পারাপারে কষ্টের সীমা নেই।