যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি ইহুদী সিনাগগে হামলা হয় সমপ্রতি। এই হামলায় ৪ ইহুদিকে জিম্মি করে এক পাকিস্তানি নাগরিক। খবরটি তোলপাড় তোলে দেশটিতে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এটা সন্ত্রাসী হামলা বলে বিবৃতি দেন। হামলাকারী আটক এবং জিম্মি উদ্ধারও হয়। হামলাকারীর পরিচয় শুরুতে ধোঁয়াশায় ছিল। হঠাৎ আলোর ঝলকানি পড়ে তার উপর। তিনি বহুল বিতর্কিত,আলোচিত সাজাপ্রাপ্ত পাকিস্তানী নাগরিক আফিয়া সিদ্দিকীর ভাই। আফিয়ার নতুন করে পরিচয় দেয়ার কিছু নেই। তিনি আল–কায়েদার অপারেটর। টুইন টাওয়ার হামলায় তার যোগসূত্র মিলেছে। এফবিআই ও মার্কিন বিচার বিভাগ অনুসন্ধান শেষে ২০০৪ সালে আফিয়ার পূর্ণ তথ্য প্রকাশ করে। আফিয়া ২০০৪ সালে আফগানিস্তানেও গ্রেপ্তার হন। সন্ত্রাসী তৎপরতায় সরাসরি জড়িত থাকার দায়ে ম্যানহাটানের একটি আদালত ২০১০ সালে তাকে ৮৬ বছরের কারাদণ্ডের শাস্তি দেন। এ‘নিয়ে পাকিস্তান সরকার ক্ষোভ ঝাড়ে। ইমরান খানের নির্বাচনী ইশতেহারেও আফিয়ার মুক্তির দাবি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানী বিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিত আফিয়া ব্রান্ডিস ভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেট এর ইনষ্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়াশোনা করেছেন। ২০১৮ সালে পাকিস্তানি সিনেট তাকে ‘পাকিস্তানের জাতীয় কন্যা’ উপাধি দেয় এবং মুক্তির পক্ষে দেশে–বিদেশে সোরগোল চালু রাখে।
উগ্রবাদী আফিয়া যখন মার্কিন চৌদ্দ শিকের আড়ালে, তখন প্রায় একই প্রকৃতির অপরাধে আটক হয় তার ভাই। সেও ধর্মীয় উগ্রতায় আসক্ত। সিনাগগে হামলা, ইহুদি জিম্মি নাটক ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিষফল। পৃথিবীর কোন ধর্মই নিজ থেকে জন্ম নেয়নি। জন্ম হয়েছে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেয়। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং নানা ধর্মমতের মানুষের জরায়ুতে মানব–ভ্রূণ অঙ্কুরিত করে দেন। জন্মের পরই স্ব স্ব ধর্মমতে পরিচিত হয় শিশুটি এবং ওভারেই বেড়ে উঠে । আসলে তার মূল পরিচয় মানুষ। ধর্মীয় জরায়ু বাছাই সরাসরি স্রষ্টা বা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। সর্বজনীন এই সত্য জেনেও মানুষ কেন ধর্মান্ধ ও উগ্র হয় ? কিছু কিছু রাষ্ট্র ও রাজনীতিক কেন ধর্মীয় উগ্রতা লালন পালন করে বিশ্বব্যাপী পবিত্র ও শান্তির ধর্ম ইসলামকে হেয় করছে? এসব সূঁচালো প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। আফিয়া সিদ্দিকীর মত উচ্চ শিক্ষিতদের উগ্রবাদী হয়ে বিদেশে সাজা খাটতে হয়। আবার তাকেই পাকিস্তানি সিনেট ‘পাকিস্তানের জাতীয় কন্যা’ উপাধিতে সম্মানিত করে!
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে আনিসা আতিক নামে ২৬ বছর বয়সী এক তরুণীকে মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে পাকিস্তানের একটি ব্লাসফেমি আদালত। মৃত্যুদন্ডের পর ২০ বছরের কারাদণ্ড মানেতো লাশের উপর কুড়োলের কোপ! হোয়াটসঅ্যাপে আনিসা কী লিখেছেন, তাও প্রকাশ করা হয়নি! পবিত্র ইসলামের জন্মভূমি সৌদি আরব ধর্মীয় গোঁড়ামি ছুঁড়ে ফেলে আধুনিক শিল্প, সংস্কৃতির সব দুয়ার খুলে দিয়েছে। নারীর মর্যাদাকেও স্বীকৃতি দিয়ে প্রগতির পথে উন্নত দেশগুলোর সাথে সমানতালে এগুচ্ছে দেশটি। সেখানে পাকিস্তানি কারাগারে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা খাটছে ৮০ জন নাগরিক । যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘কমিশন অন রিলিজিয়াস ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিডম’ নামের সংস্থা তথ্যটি প্রকাশ করেছে। শুধু তাইনা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ তুলে খুন করা হয়, যে কাউকে। গত বছর শ্রীলঙ্কার এক নাগরিককেও হত্যা করা হয়। তিনি পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকারখানার ব্যবস্থাপক ছিলেন।
ইসলাম তো এমন বর্বরতা শিক্ষা দেয়নি। সত্য, ন্যায়, শান্তি, মানবসেবা ও হালাল রুজির শিক্ষা দিয়েছে। যারা ধর্মের নামে বর্বরতা, অন্যায়, অবিচার, ঘুষ ও লুটপাট চর্চা করছে, তারাই কথায়–কথায় ধর্মীয় উগ্রতা চর্চা করে নির্বিচারে। আবার পাকিস্তানসহ কিছু রাষ্ট্র রাজনীতির আবরণে এমন বর্বরতা প্রশ্রয় দিয়ে শান্তির ধর্ম ইসলামকে হেয় করে জঙ্গি ও উগ্রবাদী ধর্মের স্টিকার সাঁটানোর সুযোগ করে দিচ্ছে।
দুর্ভাগ্য, আমরাও ধর্মীয় ভন্ডামি ও উগ্রতাকে শতভাগ প্রশ্রয় দিচ্ছি। জন্মসূত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণকারী বাংলাদেশ ক্রমশ ধর্মান্ধতার নামে ধর্মীয় উগ্রতায় ঝুঁকে পড়ে। ভিতরে ভিতরে এর আবাদ শুধুই বাড়ছে–অন্যায়, অবিচার,বৈষম্য, ঘুষ, লুটপাটের সাথে পাল্লা দিয়ে। রাজনীতি যতই জ্ঞান ও শিক্ষাবিমুখ হয়ে ভোগসর্বস্ব স্থূল পেশায় রূপান্তরিত হচ্ছে, ধর্মীয় উগ্রতা ততবেশি লাই পাচ্ছে। সমূলে বিষবৃক্ষটি উৎপাটন করা না হলে আমাদের কপালেও নিশ্চিত অনেক দুঃখ আছে।