আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গ্রিন হাউস গ্যাস। শিল্পের অগ্রগতি বজায় রাখতে গিয়ে হাজার হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ঊঠেছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফাস্ট বা দ্রুত ফ্যাশন। নিজেকে উপস্থাপনের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আমরা এতটাই ব্যস্ত যে ভালোমন্দ বিচারের বিবেচনাটুকুও আমরা হারাতে বসেছি। সহজ ভাষায় যাকে বলে নিজের কবর নিজেই খুঁড়ছি। পৃথিবী নিজেও একটি গ্রিন হাউস। সাধারণত পৃথিবীতে আগত সূর্য রশ্মির সবটা ভূ পৃষ্ঠ শোষণ করেনা। বেশ খানিকটা ফিরিয়ে দেয় বায়ু মণ্ডলে ইনফ্রারেড রশ্মির আকারে। বাতাসের মধ্যে কার্বন ডাই-অঙাইড, জলীয় বাষ্প, ওজোন, নাইট্রাস অঙাইড, সিএফসি প্রভৃতি গ্যাসগুলি গ্রিন হাউসের ধর্ম বিশিষ্ট। ভূপৃষ্ঠ থেকে নির্গত ইনফ্রারেড রশ্মিগুলি এইসব গ্রিন হাউস গাসের সংস্পর্শে এলে তারা ইনফ্রারেড রশ্মিকে শোষণ করে উত্তপ্ত হয়। ফলে বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়। পৃথিবী নিজে একটি গ্রিন হাউস না হলে ক্রমাগত তাপ বিকিরণ করে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে যেত এবং জীবজগতের পক্ষে প্রতিকূল একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হত। মনুষ্য সৃষ্ট কারণে গ্রিন হাউস গ্যাসগুলো যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর সাথে পাল্লা দিয়ে ভূপৃষ্ঠের যেভাবে উষ্ণায়ন ঘটছে তাকেই গ্রিন হাউস এফেক্ট বলা যায়। অর্থাৎ গ্রিন হাউস গ্যাসগুলোর পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে বলেই পরিবেশের উষ্ণতা বাড়ছে। ইন্টার গভর্ণমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আই পি সি সি) হল একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। ১৯৯০ সালে তারা একটি রিপোর্ট পেশ করে যাতে বলা হয় বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বেড়ে চলেছে এবং এই কারণে আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এই পরিবর্তন আরও মারাত্মক হবে। এখন পোশাক প্রেমীদের জিজ্ঞাস্য হতে পারে তাদের ফ্যাশন এর সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক
কী? যুগ যুগ ধরে ফ্যাশন চলছে, চলবে, আমাদের প্রশ্ন দ্রুত ফ্যাশন নিয়ে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমরা আমাদের একদিকে যেমন আমাদের নিজেদের সংস্কৃতি ভুলতে বসেছি, অন্যদিকে নিজেদের বেঁচে থাকার স্থানটুকুও কলুষিত করছি। দ্রুত ফ্যাশন এর চাহিদা মেটাতে গিয়ে যে সব পোশাক উৎপাদন হচ্ছে তা কতটা মান সম্পন্ন তা আমরা খতিয়ে দেখি না। সুলভে, সাশ্রয়ে, জাঁকালো পোশাক পাওয়া গেলে এত কিছু ভাবনার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা বেশির ভাগ মানুষের ভাবনার কথা ও নয়। কিন্তু যখনি অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড়, তুফান, ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ি তখন কলিযুগ বলে বলে দোহাই দিতে থাকি। আমরা নিজেরাই নিজেদের দুর্বিষহ অবস্থার জন্য দায়ী কোনো না কোনো ভাবে। দ্রুত ফ্যাশনের চাহিদা পূরণে অধিক হারে পোশাক প্রস্তুত হচ্ছে। যা গ্রিন হাউস গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০১৫ সালে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ১.৭ বিলিয়ন টন কার্বন- ডাই- অক্সাইড এর জন্য দায়ী ছিল-পালস অব দি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি রিপোর্ট অনুসারে- এই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ২০১৫ সালে প্রায় ৫% মনুষ্যসৃষ্ট কার্বন-ডাই-অঙাইড নিরসন করে- যা ২০১৮ সালে ৮% এ দাঁড়ায়। আই পি সি সি এর গবেষণা মতে বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মধ্যে রাখতে হবে। গ্রিন হাউস গ্যাসের নিরসন ৪৫% এ কমিয়ে আনতে হবে ২০৩০ এর মধ্যে-আর শূন্য কোটায় আনতে হবে ২০৫০ এর মধ্যে। কিন্তু এই শূন্য কোটায় গ্রিন হাউস নিরসন এর জন্য মানুষের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজনীয় শর্ত যা ফ্যাশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে দুভাবে-
(ক) আমরা কতটুকু পোশাক উৎপাদন করবো এবং (খ) ঐ পোশাক আমরা কিভাবে ব্যবহার করবো। গবেষণা করে দেখা গেছে পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত প্রায় দুই- তৃতীয়াংশ কাঁচামাল জলবায়ুতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। যেখানে সিনথেটিক ব্যবহৃত হয় ৬৫% এবং তুলার ব্যবহার হয় ২১%। ২০১৪ সালে ৪৬.১ মিলিয়ন টন পলিসটার তৈরি হয়েছিল যা মূলত তৈরি হয় তৈল, আর কাঁচামালের নির্যাস থেকে-এই পলিসটার বায়ুমণ্ডলে ৬৫৫ মিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ করে যা সর্বমোট ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি নিঃসরণের ৪০ শতাংশ। যদিও কৃষিজাত কাঁচামাল হিসেবে তুলার ব্যবহার কার্বন নিঃসরনে কম প্রভাব ফেলে কিন্তু মাটিতে রাসায়নিক সার হিসেবে যে নাইট্রাস- অক্সাইড ব্যবহৃত হয়, যা এক ধরনের গ্রিন হাঊস গ্যাস। এই গ্যাস কার্বন- ডাই- অঙাইড অপেক্ষা ৩০০ গুণ বেশি উষ্ণতা প্রবর্ধক গ্যাস। এছাড়া পোশাক প্রস্তুতকরণ, স্থানান্তরকরণ, প্যাকেজিং এবং বিক্রিতে প্রতিটি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে, ১ শতাংশেরও কম পোশাক কারখানা ২০% সুতাকে পুনঃব্যবহার করে নতুন পোশাক তৈরি করছে, বাকিগুলো যাচ্ছে ভাগাড়ে অথবা পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। দ্রুত ফ্যাশন এর ফলে যে কার্বন নিরসন হয়, তা গ্লোবাল নিঃসরণের শতকরা ১০ ভাগ। ওয়ার্ল্ড ওয়াটার সাপ্লাই এর ভোক্তা হিসেবে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির স্থান দ্বিতীয় বৃহত্তম। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির করণীয় : ফ্যাশনের এই জলবায়ু দূষণ দূরীকরণে ২০১৮ সালে ডিসেম্বরে অনেক মর্যাদা সম্পন্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ড এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি চার্টার ফর ক্লাইমেট অ্যাকশন প্রবর্তন করেন- তার মধ্যে ছিল বিশ্ব খ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড এইচ এন্ড এম, এডিডাস, পুমা, বারবারি এবং স্টেলা ম্যাক কার্টনে যেখানে বিশ্ব মানের প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠান মেয়ারস্ক ও ছিল। চারটি পদ্ধতিতে ফ্যাশন ব্র্যান্ড গুলো ফ্যাশনের এই ঋণাত্মক প্রভাব হতে মুক্ত হতে পারে-
ক) সব ধরণের কাঁচামালকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। যেমন- পলিসটার কে পুনঃব্যবহার্য উপাদানে পরিণত করতে হবে যা ৪০ শতাংশ কার্বন পদ চিহ্ন হ্রাস করতে পারে। পেটাগোনিয়া পোশাক ব্র্যান্ড পুনঃ ব্যবহার্য পলিসটার এর জন্য পরিচিত। আর অনেক বড় বড় ব্র্যান্ড যেমন নাইক, এইচ এন্ড এম, এবং টার্গেট এরা টেকসই সিনথেটিক ব্যবহারের মধ্যে প্রথম দশ ব্যবহারকারীদের তালিকায় আছে। ঠিক একই ভাবে প্রচলিত তুলার পরিবর্তে জৈব তুলা বা অরগানিক তুলার উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়াতে হবে যা কার্বন নিরসন হ্রাস করবে।
খ) মান শৃঙ্খল (ভ্যালিউ চেইন) সহ শক্তি সঞ্চয় তৈরি কমিয়ে নিতে হবে। ওয়্যার হাঊস, স্টোর হাঊস এবং অফিসে শক্তি (লাইট) ব্যবহার কমাতে হবে।
গ) পোশাক কে ছুঁড়ে ফেলে না দিয়ে পুনঃ ব্যবহারের প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
ঘ) দ্রুত ফ্যাশন সংস্কৃতি পুনঃ বিবেচনায় আনতে হবে। কমন অবজেক্টিভ সি ই ও তামসিন লেজেঊনে বলেন, দ্রুত ফ্যাশন পরিবেশের জন্য মৌলিকভাবে টেকসই হীন। পোশাক উৎপাদন গত ২০ বছরে শুধু দ্বিগুণ হয়েছে তা নয়, মানুষের পোশাক পরিধানের হারও বেড়েছে কিন্তু স্থায়িত্ব কমেছে। কিছুদিন ব্যবহারের পর জমা হচ্ছে ভাগাড়ে। প্রতি বছর ৮৫ শতাংশ পোশাক ভাগাড়ে যায়। অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে পোশাকের বর্জ্য ট্রাক হয় পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে, না হয় মাটিতে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। দি এলাইয়েন্স ফর সাসটেইনেবল ফ্যাশন এর মতে বর্তমান অবস্থার ধারাবাহিকতা থাকলে এই পোশাক ইন্ডাস্ট্রির বার্ষিক কার্বন নিরসনের মাত্রা পৌঁছাবে ২৬ শতাংশ-২০৫০ এর মধ্যে। নিজেকে প্রতিনিয়ত নতুন পোশাকে সাজাতে গিয়ে আমরা যে পৃথিবীর সুন্দর পোশাক টাকে দূষণে দূষণে জর্জরিত করছি তা হয়তো আমরা নিজেরাও জানি না।
আমাদের করণীয় :
ক) অতিমাত্রায় পোশাক পরিবর্তনের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে,
খ) পোশাক ছিঁড়ে গেলে সেলাই করে পরার অভ্যাস গড়তে হবে,
গ) ভাল মানের কাপড় কেনার নিশ্চয়তা বাড়াতে হবে, ১০ টি না কিনে ১টি ভাল মানের পোশাক কেনার মানসিকতা তৈরি করতে হবে,
ঘ) সিনথেটিক, পলিসটার জাতীয় কাপড় বর্জন করে সুতি কাপড় পরিধানের অভ্যাস গড়তে হবে, এবং
ঙ) দান করার প্রবণতা বাড়াতে হবে। এমন অনেক পোশাক তৈরির কারখানা আছে যেখানে রিসাইক্লিং করা হয়, যা টেক্সটাইল রিসাইক্লিং বলে, যারা অব্যবহৃত কাপড় সংগ্রহ করে এবং তা দিয়ে অন্য প্রোডাক্ট তৈরি করে। বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়ে নানা পদক্ষেপ ইতোমধ্যে শুরু করেছে। নিজেদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াসে আমরা পৃথিবীতে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবো। পরবর্তী প্রজন্মকে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী আমরা উপহার দিতে পারবো। ফ্যাশন মানে শেকড়কে ভুলে যাওয়া নয়, বরং পরম্পরা ধরে রাখা। এ দিনের পরেও দিন আছে, থাকবে, কিন্তু একটু সচেতনতায় আমরা আমাদের কাজের ছাপ রেখে যেতে পারি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
লেখক : পিএইচ ডি গবেষক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়