দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট প্লেসেস-এ জেবুন নেসা মসজিদ : স্থাপত্যশিল্পে এক অনন্য দৃষ্টান্ত

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ২৭ মে, ২০২৫ at ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ

সমপ্রতি টাইম ম্যাগাজিনের ‘দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট প্লেসেস অব ২০২৫’ তালিকার১০০ এ স্থান পেয়েছে সাভারের জেবুন নেসা মসজিদ। বৈশ্বিক এই তালিকায় প্রথমবার স্থান পেলো কোন বাংলাদেশি স্থাপনা। প্রশ্ন হলো কেন বাংলাদেশের একটি মসজিদ দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট প্লেসেস এ স্থান পেলো?

জেবুন নেসা মসজিদে যাঁরা যাবেন, তারা এই স্থাপত্যকে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করার অনুভূতি পাবেন। প্রথমে সিঁড়ি বা র‌্যাম্প বেয়ে উপরে উঠে চোখে পড়বে চতুর্ভুজ একটি প্যাভিলিয়ন ফ্লাটফর্মের। এই চতুর্ভুজের চারপাশে রয়েছে চারটি বাগান। চারটি বাগানের ভেতর সবচেয়ে বড়টি দক্ষিণপূর্ব দিকে। সেখানে বাগানের ভেতর দিয়ে একটা ছাতিমগাছকে ঘিরে চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে। ছাতিমগাছটা অনেকটা ছাতার মতো ছায়া দেয়। সেদিক দিয়ে উপরে উঠলে নারীদের নামাজের জায়গা। এর পশ্চিম পাশে রয়েছে একটি লেক। যেটিকে সেখান থেকে ভালোভাবে দেখা যায়। চতুর্ভুজ আকৃতির মসজিদের অবয়বের ভেতরে ঢুকলেই গোলাকৃতির বড় গম্বুজের দেখা মিলবে। গম্বুজের ভেতর গিয়ে দাঁড়ালে একটা শান্ত শীতল বিশালত্বের খোঁজ পাওয়া যায়। যার সামনে বিশাল লেক। মসজিদটা গড়া হয়েছে মনোলিথিক আর্কিটেকচারে। মনো মানে এক। মনোক্রোম রঙে বা এক রঙে রাঙা। ইসলাম ধর্মের মানুষেরা একজন সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন। সেই ‘একক’ ব্যাপারটা এই স্থাপত্যেও উঠে এসেছে। সিমেন্ট, রং, ইটসহ নির্মাণসামগ্রী সব স্থানীয়। মোজাইকে মার্বেলের বদলে ইটের টুকরা ব্যবহার করা হয়েছে, কারিগরেরা সবাই দেশি। মসজিদটিকে তাই ‘লোকালি হ্যান্ড মেইড’ বলা যায়।

মসজিদের লালচে গোলাপি রংটা এই অঞ্চলের টেরাকোটা, চুনসুরকি ও বাংলার মৃৎস্থাপত্যের রং ও টেক্সচার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নেওয়া হয়েছে। ইসলামি স্থাপত্যে যে কোরিওগ্রাফি জালির ব্যবহার থাকে, এখানেও সেটি রয়েছে। তবে সেটি কেবল দেখার সৌন্দর্যের জন্য নয় বরং প্রাকৃতিক আলোবাতাস ভেতরে ঢোকানোর জন্য। তাই মসজিদে কোনো ফ্যান বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তবে মসজিদের ভেতর সব সময় লেক থেকে আসা ঠাণ্ডা বাতাস ফিল্টার হয়ে চলাচলের ব্যবস্থা আছে। বেশ কিছু অতি সাধারণ প্রজাতির স্থানীয় গাছ লাগানো হয়েছে। যেমন পশ্চিমে দুটি শিমুলগাছ আছে। সেই সঙ্গে নিচেও আছে লেমনগ্রাস, রেইন লিলিসহ নানা প্রজাতির গাছ। এমনভাবে গাছগুলো বাছাই করা হয়েছে, যেন সারা বছর কোনো না কোনো রঙিন ফুল ফুটে থাকে। এ ছাড়া মসজিদে ঢোকার পথে, অজুখানার পাশেসহ বিভিন্ন জায়গায় বাঁশঝাড় লাগানো হয়েছে। এই বাঁশঝাড়ের মাধ্যমে গ্রামবাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঢুকে পড়েছে মসজিদ প্রাঙ্গণে।

মসজিদটির অবস্থান আইডিএস গ্রুপের তৈরি পোশাক কারখানা আশুলিয়ার জামনগরে দরগার পাড়ে।‘স্টুডিও মরফোজেনেসিস লিমিটেড’ এর পরিচালক এবং অংশীদার সায়কা ইকবাল মেঘনা কর্তৃক ডিজাইন করা জেবুন নেসা মসজিদটি যুগান্তকারী নকশার জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। সায়কা ইকবাল মেঘনা বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আগে থেকেই এই কারখানায় স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘স্টুডিও মরফোজেনেসিস লিমিটেড’ বেশ কিছু কাজ করেছে। এর মধ্যে টেকসই সবুজ কারখানা গড়ার কাজ অন্যতম। সেই ধারাবাহিকতায় কারখানা প্রাঙ্গণের ফাঁকা জায়গায় মসজিদ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থপতি মেঘনাকে। মেঘনা ও তার টিম সমস্ত মেধা মনন উজাড় করে তৈরি করেছেন এই অনন্য মসজিদটি।

টাইম ম্যাগাজিনের স্বীকৃতির আগে মসজিদটির স্থপতি মেঘনা ভারতের জেকে সিমেন্ট লিমিটেডের আয়োজনে ‘আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার’ সম্মাননা পেয়েছে। অনলাইন আর্কিটেকচার প্ল্যাটফর্ম ডিজিন থেকে ‘টপ ফাইভ সিভিক প্রজেক্টস’ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আর্ক ডেইলির ‘টপ ফাইভ রিলিজিয়াস প্রজেক্ট’ নির্বাচিত হয়েছে।

প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কর্মী এই তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তাঁদের জন্যই মূলত তৈরি করা হয়েছে এই মসজিদ। তবে বাইরে থেকে গিয়েও সেখানে নামাজ পড়া যায়। ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক মানুষ মসজিদটি দেখতে এসেছেন। মার্কিন স্থপতিদের একটি দল মসজিদটি ঘুরে গেছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে এক নারী এই মসজিদে এসে নামাজ পড়ে গেছেন এবং ফিরে গিয়ে তিনি ইনস্টাগ্রামে বার্তাও পাঠিয়েছেন। একজন ফরাসি স্থপতি ঘুরে গেছেন মসজিদটি। তারা লিখেছেন স্থাপনাটি তাঁদের ভালো লেগেছে। একটা স্থাপনা যখন দেশ, ভাষা, সংস্কৃতির গণ্ডি পেরিয়ে অন্যদেরও ভালো লাগে।এই কাজের সাথে জড়িত মানুষগুলোর কীর্তি আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ পায়। আর সেটিই হলো স্থপতি হিসেবে আমাদের কৃতী সন্তানদের পরম পাওয়া।

আসলে আমাদের দেশের মানুষের সক্ষমতা বিশ্ব মানের। তাদের সক্ষমতা নিয়ে কখনো সন্দেহ ছিলো না। তার নজিরও আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময় ও বহুবার। তার আরেকটি উদাহরণ হলো, কয়েক মাস আগে দ্য জনস হপকিনস সেন্টার ফর বায়ো ইঞ্জিনিয়ারিং ইনোভেশন এন্ড ডিজাইনিং এর ‘ডিজিটাল হেলথ ট্র্যাক’ বিভাগে হার্ভার্ড, এমআইটি, ক্যালটেক, স্ট্যানফোর্ডকে হারিয়ে প্রথম হয়েছে বুয়েটের পাঁচ শিক্ষার্থীর দল ‘নিওস্ক্রিনিক্স’। তারা প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত করার এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। যার মাধ্যমে একজন নারী নিজেই স্তন ক্যানসারের লক্ষ্মণ ও সম্ভাব্যতা যাচাই করতে পারবেন। যা সত্যিই বিস্ময়কর। প্রতিবছর একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ‘দ্য জনস হপকিনস সেন্টার ফর বায়োইঞ্জিনিয়ারিং ইনোভেশন অ্যান্ড ডিজাইনিং’। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল প্রকৌশল বিভাগের একটি প্রতিষ্ঠান। এবারের প্রতিযোগিতায় তিনটি বিভাগে অংশ নেয় ২০০ বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪৪০টি দল। নিওস্ক্রিনিক্সের পাঁচ সদস্য হলো ফাহমিদা সুলতানা, এইচ এম শাদমান, সাদাতুল ইসলাম, মো. হাসনাইন আদিল ও পৃথু আনান।

এতো মেধাবী একটি জাতি হওয়া সত্ত্বেও আমরা অতি মাত্রায় অস্থির। আর সেজন্য আমাদের অর্জনগুলো অতিদ্রুত আমরা হাতছাড়া করে ফেলি। কোনো কিছু মনঃপূত না হলে আমরা এর তীব্র বিরুদ্ধাচরণ করি। একটু ধৈর্য ধরে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করি না। সে জন্য রক্ত দিয়ে অর্জিত অনেক সাফল্য আমরা ধরে রাখতে পারি না। আর এটাই এই জাতির সবচেয়ে দুঃখের ও বেদনার বিষয়।

লেখক: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিতার্কিক হিসেবে নৈতিকতা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে সমপৃক্ততা
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম শহরের অরক্ষিত খাল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা