দোষটা আসলে কার

করবী চৌধুরী | মঙ্গলবার , ৪ জুন, ২০২৪ at ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ

আজকালকার ছেলেমেয়েদের মাঝে ধৈর্যটা কেন জানি বড্ড কম!’

আমাদের উত্তর প্রজন্ম এই দোষারোপটা হরহামেশাই শুনে আসছে আমাদের থেকে।

আচ্ছা, আজকের প্রজন্মের এই কম ধৈর্যের কারণটা কালকের নয়তো?

কাল বলতে সর্বদাই যে আগামীকাল হবে তা কিন্তু নয়। কালের গর্ভে ফেলে আসাটা অতীত কালটাও কালের মধ্যেই পরে।

আমরা প্রায়শই কারণেঅকারণে বর্তমানকালের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো আলোচনা করার সময় ফেলে আসা কালটাকে সামনে নিয়ে আসি। এসময়কার জেনারেশনের অধৈর্যপনা, চারিত্রিক অসামঞ্জস্যগুলো তুলে ধরার সময় আমরা আমাদের সে সময়টাকে স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করে থাকি।

কিন্তু একালসেকালের মাঝে তুলনা করতে গিয়ে আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি যে, আমাদের ফেলে আসা কালটা আজকের প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি বলেই ওরা সবকিছুতেই এতটা অধৈর্য, এতটা অসহিষ্ণু!

দারুণ মজার একটা লেখা কোথায় জানি পড়েছিলাম। আমাদের ছোটবেলায় আমরা কী কী কারণে মার খেতাম, তার ৩২টা কারণ সেই লেখায় উল্লেখ করা ছিল, যার বেশিরভাগই অবশ্য অকারণ আর হাস্যকর আজকের প্রজন্মের কাছে। তবে সেই লেখাটির শেষে একটা অমূল্য লাইন ছিল যে কারণে লেখাটি আমার এখনো মনে রয়ে গেছে। লাইনটা হলো,

আমাদের সময়ে আমরা কাঁদতে কাঁদতে হাসতে জানতাম।’

এই যে, কাঁদতে কাঁদতে হাসতে পারার মত গুণটা আমাদের মাঝে ছিলো, সেটার একমাত্র কারণ হচ্ছে ‘অনুশাসন’, যেটা সেসময় তাদের উত্তরসূরীদের মাঝে গেঁথে দিতে আমাদের অভিভাবকেরা জানতেন।

ভালোবাসার পরিধি আর শাসনের সীমারেখার মধ্যে চরিত্র গঠনের মূলমন্ত্র যেটা তাঁরা তাঁদের পূর্বসূরি থেকে পেয়েছিলেন, সেটা সফলভাবেই তাঁদের উত্তরসূরির মাঝে তারা ইনজেক্ট করতে পেরেছেন। কিন্তু আমরা যারা সেসময়ের ছাত্র তারা সেই মূলমন্ত্রটি আত্মস্থ করতে পেরেছি বটে, কিন্তু অভিভাবক হয়ে আমাদের উত্তর প্রজন্মকে তার কিছুমাত্র দিয়ে প্রভাবিত করতে পারিনি।

নিজেরা হয়তো সংযত হয়েছি কিন্তু অনুশাসনের মূলমন্ত্রটা আমাদের আগামীকে শেখাতে পারিনি।

প্রশ্ন হলো, কেন পারিনি?

পারিনি কারণ, নিজেরা শুধুমাত্র অশ্বমেধ ঘোড়ার মতো নিজেদের জীবনের বাজি জেতার দৌড়ে জিততে চেয়েছি। ভুলেছি আমাদের পাশে ছুটে চলা ছোট ছোট ঘোড়ারূপী সন্তানদের কথা। নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে তাদের চুপ করিয়ে রেখেছি। চাইলেই সবকিছু পাইয়ে দিচ্ছি তাদের। সময়কে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র নিজেদের ছোটার পথে যাতে তারা বিঘ্ন না ঘটাতে পারে সেজন্য তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি নিত্যনতুন গেজেট। আধুনিক প্রজন্ম গড়ে তোলার গোলকধাঁধায় ফেলে কেড়ে নিচ্ছি তাদের শৈশব।

আদরের সন্তানকে মাঠঘাটের অভব্যপনা শেখা থেকে মুক্ত রাখার অজুহাতে মানুষের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে তাকে স্কোয়ার ফুট মাপা ঘরের আবদ্ধতার মাঝে বন্দী রেখে কাগজেকলমে তোতাপাখির মত একটাই বুলি শিখিয়ে যাচ্ছি যে,

পৃথিবীর সমস্ত সুখ আর চাওয়াপাওয়া লুকিয়ে আছে একমাত্র অর্থে, কেরিয়ারে আর প্রতিপত্তির মাঝে।

তাই সময়ের সাথে দৌড়াও, জোরে, আরো জোরে! সবার আগে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে, সমাজে নামযশ করতে হলে ছোটো.. নইলে তোমার জীবন বৃথা!

এটাই যেন সন্তানের প্রতি এযুগের অধিকাংশ পিতামাতার অনুশাসন। ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে নিরুপায় সন্তানেরাও বাবামায়ের ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পেছনে পড়ে থাকে তাদের নাম নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা, ভাবনা, ভালোলাগা আর সোনালি শৈশব। কিছু পাওয়ার বদলে অনেকটাই হারিয়ে কেউ কেউ হয়ে পড়ে হতাশাগ্রস্ত।

অধিকাংশ পিতামাতা সন্তানকে মাধ্যম করে যে নিজেদের প্রতিপত্তি, নিজেদের সম্মান বাড়ানোর অসৎ পন্থাটা অনুসরণ করেন সেটা কি কালের বিচারে সঠিক হলো? তাহলে আজকের প্রজন্মের উপর দোষ কিভাবে চাপাতে পারি আমরা।

এই হতাশা তো ওদের জন্মগত ছিলো না। ওদের মধ্যে স্থাপন করেছি তো আমরাই।

অতিরিক্ত ভালোবাসতে গিয়ে ভালোবাসার সেই না পাওয়া, কিংবা শাসন, ক্ষেত্রবিশেষে হালকা প্রহার কিছুই পায় নি ওরা। ওদের কোনদিন বুঝতেই দেওয়া হয়নি যে, জীবনে সব চাওয়া পূর্ণ হয় না।

কিছু না পাওয়ার ভেতরে পাওয়ার জেদ লুকিয়ে থাকে, সেগুলোকে অর্জন করে নিতে হয়।

এসব কিছুই ওদের শেখাইনি আমরা।

আর শেখাবোই বা কিভাবে? নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতে নিজেরাই তো ভুলে গেছি পিতৃপ্রদত্ত অনুশাসনগুলোকে।

এখন বলুন, দোষ কার? নিজেদের প্রশ্ন করে দেখুন তো এই অধৈর্যপনার, চারিত্রিক অসহিষ্ণুতার জন্য দায়ী কি ওদের বর্তমান আজ নাকি আমাদের অতীতের কাল?

ওদের ধৈর্য ধরার রাস্তায় পাঁচিল তুলে দিয়েছি তো আমরাই। হ্যাঁ, আমরা যারা ওদের অভিভাবক, তারাই। সময় কাউকেই ক্ষমা করে না। গাছ নিজে নিজে লড়াই করে হয়তো বাঁচতে পারে কিন্তু ভালো ফুলফলের জন্য চাই সঠিক পরিচর্যা। গাছ পুঁতলেই যেমন মালি হওয়া যায় না, তেমনি সন্তান জন্ম হলেই সুসন্তানের পিতামাতা হওয়া যায় না।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিজের প্রতি ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধশিল্পনগরী চট্টগ্রাম : স্বপ্ন ও বাস্তবতা