দৈনিক আজাদীর জন্য এক মহা আনন্দের দিন আজ। কেননা আজ ৫ই সেপ্টেম্বর ২০২৩ আজাদী পূর্ণ করেছে প্রতিষ্ঠার ৬৩ বছর। পদার্পণ করলো ৬৪ বছরে। এটি বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে একটি স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। সবদিক দিয়ে অনিশ্চয়তার এ যুগে একটি পত্রিকার ৬৪ বছরে পদার্পণ রীতিমত ঈর্ষণীয় ব্যাপার। দৈনিক আজাদীকে বলা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র। কিন্তু তার জন্ম বাংলাদেশের জন্মের ১১ বছর ৩ মাস ১১ দিন আগে, অর্থাৎ ১৯৬০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর। এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় লাভের পর ১৭ ডিসেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদী। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ‘নিরীক্ষা’ সেপ্টেম্বর–ডিসেম্বর ১৯৯৯ সংখ্যায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রেস ইনস্টিটিউটকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়, কেননা তাঁরা আজাদীকে এই স্বীকৃতিটা দিতে কার্পণ্য করেননি।
আমরা মনে করি, ৬৪ বছর ধরে আজাদীর অগ্রযাত্রা, সেই সাফল্য শুধু আজাদীর নয়, যাঁরা মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছেন, পেশাজীবী সাংবাদিক এবং যাঁরা পত্রিকার পাঠক, এ সাফল্য তাঁদের সবার। এতো বছর ধরে টিকে থাকার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, এ পত্রিকার সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে, দেশের স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা আছে।
আজাদী চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের সংবাদপত্র। সুদীর্ঘ সময় ধরে অবহেলিত চট্টগ্রামের দুঃখ–হাহাকার–সংকট আর সম্ভাবনার কথা তুলে ধরতে ধরতে এটি পরিণত হয়েছে এই অঞ্চলের মানুষের ভালোবাসার মুখপত্রে। চট্টগ্রামের জনমানুষের কথা বলার জন্য– সর্বোপরি বঞ্চিত ও অবহেলিত জনপদের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার লক্ষ্য নিয়ে ৬৪ বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল দৈনিক আজাদী। আজাদী আজ শুধু একটি সংবাদপত্রই নয়, এটি এখন চট্টগ্রামের আয়না হিসেবেও স্বীকৃতি অর্জন করেছে। আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আবদুল খালেক হলেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার, যিনি নিজের উজ্জ্বল পেশা ছেড়ে লাইব্রেরি, প্রেস ও পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন এই জনপদের পশ্চাদপদ মুসলিম সমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের কর্মজীবন শুরু হওয়ার কথা ছিল শিবপুরেই। তড়িৎ প্রকৌশলী হিসেবে সেখানে খুব লোভনীয় বেতনে তার চাকরি হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। মা ও মাতৃভূমির টানে তিনি ফিরে এসেছিলেন দেশেই। অবশেষে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে চাকরি নেন। চাকরি জীবনের প্রথম থেকেই তিনি নিষ্ঠা ও সততার পরিচয় দিতে শুরু করেন। শ্রম ও মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি কর্মক্ষেত্রকে পবিত্র করে তুলেন। সহযোগী তড়িৎ প্রকৌশলী থেকে তিনি ক’বছরে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হয়ে যান। পরে কর্তৃপক্ষ তাঁকে প্রধান প্রকৌশলীর পদ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন চাকরি করেননি। মূলত ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকেই তিনি চাকরির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কর্তৃপক্ষ প্রথমে বিশ্বাস করেন নি যে, তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন। তাই আর্থিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিসহ তাকে আরো বড় পদ দিতে চাইলেন। কিন্তু না, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হঠলেন না। তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও পরহিতব্রতে নিজেকে অধিকতর জড়িয়ে রাখার মানসে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। চাকরিতে থাকাবস্থায় ইঞ্জিনিয়ার খালেক ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কোহিনূর লাইব্রেরি এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। শিল্পী সাহিত্যিকদের লেখা প্রকাশনায় তিনি যথেষ্ট সহযোগিতা করতেন, অনুপ্রেরণা জাগাতেন। মননশীল সাহিত্য সংকলন প্রকাশের ক্ষেত্রেও তাঁর কোহিনূর প্রেস ছিল উল্লেখযোগ্য। অন্নদাশংকর রায়, আশুতোষ চৌধুরী, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক এদের লেখায় সমৃদ্ধ সাহিত্য সংকলন ‘পূরবী’ ছাপানো হতো কোহিনূর প্রেস থেকেই। তাঁর পরিচালিত কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসি নি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’– কী অসাধারণ সাহস থাকলে বাঙালি বিদ্বেষী পাকিস্তান সরকারের হিংস্রতার সময় একটি প্রেস এমন সাহসী ভূমিকা নিতে পারে।
ভাষা ও দেশ মাতৃকার সেবায় নিবেদিত ব্যক্তিত্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার পরবর্তী সময়ে সেই কোহিনুর প্রেস থেকে আজাদী প্রকাশে ব্রত হন। এর আগে অবশ্য তিনি কোহিনূর নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। সেই কোহিনূর পত্রিকাটি মহান ভাষা আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। আজাদী প্রকাশের দুই বছরের মাথায় ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। এ সময় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আমৃত্যু কাজ করে যান।
সংবাদপত্রের মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আজাদী সবসময় আপোসহীন ভূমিকা পালন করে এসেছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে দৈনিক আজাদী প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষেই বলিষ্ঠ ভূমিকা নেয়। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সকালে স্বাধীন বাংলাদেশে একমাত্র সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীই প্রকাশিত হয়। ‘জয়বাংলা–বাংলার জয়’ ব্যানার শিরোনাম দিয়ে দৈনিক আজাদী বিজয়ের কথা চট্টগ্রামে নিশ্চিত করে। আর এরই মাধ্যমে দৈনিক আজাদীই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে স্বীকৃত হয়। দেশের মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের মতে, জয় বাংলা বাংলার জয় স্লোগানে স্বাধীনতার প্রথম প্রহর ১৭ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদীর প্রকাশ ঐতিহাসিক।
সংবাদপত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘আজাদী’ শুধুমাত্র একটা পত্রিকা নয়, একটা দর্পণ। সেখানে মানুষ তার অতীত ও বর্তমানকে দেখতে পাই এবং ভবিষ্যতকেও সে দেখতে পারবে। সেই ক্ষেত্রে ‘আজাদী’ অন্তত এই অঞ্চলের মানুষকে এই বিষয়টি ভাবতে শেখায়। ‘আজাদী’ আজ কেবল একটা মিডিয়া নয়, এটা বর্তমানে একটা আন্দোলন। এই আন্দোলন হিসাবেই ‘আজাদী’কে এই অঞ্চলের মানুষকে সংঘটিত করতে হবে যাতে এই অঞ্চল প্রকৃত প্রস্তাবেই শুধু বাংলাদেশের নয়, প্রাচ্যের নয়, সমগ্র পৃথিবীর নান্দনিক জগতের প্রবেশ দ্বারে পরিণত হতে পারে। এই বর্তমান যুগে করণীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মানুষের মনে একটা গুণবাচক ও ইতিবাচক ভাবনা তৈরি করা। এই ক্ষেত্রে ‘আজাদী’র একটা বিশাল ভূমিকা আছে। আর এটিই হোক ‘আজাদী’র অনুপ্রেরণা।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আজাদী দৃঢ়ভাবে পালন করে এসেছে কল্যাণমুখী, মানবব্রতী ও দেশব্রতী ভূমিকা। দলমতের ক্ষেত্রে আজাদী অনুসরণ করেছে নিরপেক্ষ ইতিবাচক ভূমিকা। আর এ জন্য দলমত নির্বিশেষে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে আজাদী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে চলা প্রগতিশীল এই পত্রিকাটির মূলধন পাঠকসমাজ। এই পাঠক সমাজই আজাদীকে বাঁচিয়ে রাখবে। সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৯ সালে আজাদী প্রথম লাভ করে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল পদক। দৈনিক আজাদী আজ শুধু একটি সংবাদপত্রই নয়, এটি এখন চট্টগ্রামের আয়না হিসেবেও স্বীকৃত।