(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৪ঠা মার্চ : প্রথম সংবাদ (ব্যানার হেড লাইন) – ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবীতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য শেখ মুজিবের আহ্বান / করও রাজস্ব আদায় বন্ধ রাখিয়া সত্যাগ্রহ শুরু করুন।’ দ্বিতীয় সংবাদ (৪ কলামে) পরস্পর বিরোধী জনতার সংঘর্ষের ও গুলি বর্ষণে / ৭৫ নিহত ও কয়েকশত আহত। সংবাদে বলা হয় গতকাল সকালে পাহাড়তলী এলাকায় ওয়ারলেস কলোনী, পুরাতন ইস্পাহানী ফারর্ম গেইট কলোনী, টাইগার পাশ, ফিরোজশাহ কলোনী ও খুলশী কলোনী সংঘর্ষের ফলে ৭৫জন নিহত ও কয়েকশত আহত হইয়াছে বলে প্রকাশ’। দুই কলামের তিনটি পৃথক সংবাদ ঃ ‘মিছিলে জনসভা – গণজমায়েত চট্টগ্রামের সর্বত্র পূর্ণ হরতাল পালিত লালদিঘীর জনসভার ডাক/শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন শাসনতান্ত্রিক সংকটকল্পের বৈঠকের জন্য / দ্বাদশ পার্লামেন্টারী নেতার প্রতি প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ’। এক কলামের দুইটি সংবাদ ঃ ‘শেখ মুজিবের প্রত্যাখ্যান ও আহুত নেতৃত্ব সম্মেলন/পিপিপি’র যোগদানের সিদ্ধান্ত’ (সংবাদ দুইটি প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ সংবাদের দুই পাশে ছিল)।
৫ই মার্চ : প্রথম সংবাদ (৬ কলামের) ‘বীর জনতার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার প্রতি শেখ মুজিবের অভিনন্দন যে কোন মূল্যেই শোষিত বাংলায় মুক্তি সংগ্রাম অব্যাহত রাখিতে হইবে’। দুই কলামের দুইটি সংবাদ ঃ ‘প্রেসিডেন্ট আহুত সম্মেলন বর্জনের জন্য শেখ মুজিবের সিদ্ধান্তের প্রতি অভিনন্দন ও দাংগা–হাংগামা খুন জখম ও লূটতরাজের ঘটনায় / চট্টগ্রামের বিভিন্ন মহলের গভীর শোখ প্রকাশ।’ এক কলামের দুইটি সংবাদ ঃ ‘চট্টগ্রাম ১২০ জন নিহত ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত’।
৬ই মার্চ : প্রথম সংবাদ (৪ কলামের) আকাশ বাণী বেতার প্রচার সম্পর্কে শেখ মুজিব ‘সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য কোন বিদেশী শক্তিকে অনুরোধ করি নাই।’ দ্বিতীয় সংবাদ (৩ কলামের) ‘শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্য সর্বদলীয় কমিটি গঠিত / উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের দাংগাজনিত পরিস্থিতির পর্যালোচনা / চট্টগ্রামে শান্তি কমিটি : এম.আর. সিদ্দিকী কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত’ এক কলাম সংবাদ ঃ ‘ঢাকায় / সেনাবাহিনীর ব্যারাকে ফিরিয়া যাইবে।’
৭ই মার্চ : প্রথম সংবাদ (৫ কলামের) ঃ ‘পাকিস্তানের সংহতি অক্ষুণ্ন রাখিতে প্রেসিডেন্টের ঘোষণা ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহুত’ / দ্বিতীয় সংবাদ ঃ (২ কলামের) ‘মিছিল ও সভার মাধ্যমে/ চট্টগ্রামের গতকল্য পূর্ণ হরতাল পালিত’। তিনটি এক কলাম সংবাদ ঃ ‘আজগর–মুজিব আলোচনা, লে.জে. টিক্কাখান গভর্ণর নিযুক্ত ও শান্তি কমিটির মিছিল।’
৮ই মার্চ : প্রথম সংবাদ (৫ কলামের) ঃ ‘রেসকোর্সের লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশে শেখ মুজিব / চারি দফা শর্ত মানিয়া লইলে অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্ন বিবেচনা করা যাইতে পারে।’ দ্বিতীয় সংবাদ (৩ কলামের) ‘সরকারী মহল নীরব/ঢাকার বেতার কেন্দ্রের আকস্মিক স্তব্ধতায় জনমনে জল্পনা–কল্পনার ঝড় সৃষ্টি।’ দুই কলামের সংবাদে ‘শেখ মুজিবের ঘোষণার প্রতি চট্টগ্রামের সমর্থন জ্ঞাপন’। এক কলাম সংবাদে ‘টিক্কা খানের ঢাকা উপস্থিতি’। ৪র্থ পৃষ্ঠায় দুই কলাম সংবাদে ‘সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রেসনোট / গোলযোগ কালে প্রদেশে মোট ১৭৮ জন নিহত ও ৩৫৮ জন আহত হইয়াছে।’
৯ই মার্চ : পবিত্র মহররম উপলক্ষে বন্ধ ছিল।
১০ই মার্চ : প্রথম সংবাদ (৪ কলামের) ‘পল্টনের জনসমাবেশে / মাওলানা ভাসানী / শেখ মুজিবের সহিত মিলিয়া ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করিব’। দুই কলামের এক সংবাদে ‘গভর্ণর পদে টিক্কা খানকে শপথ নিতে বিচারপতি সিদ্দিকীর অস্বীকার : শেখ মুজিবের অনুমতি ব্যতীত নবনিযুক্ত গভর্ণর লে. জে. টিক্কাখানকে গভর্ণর হিসাবে শপথ বাক্য পাঠ করাইতে আমাদের প্রধান বিচারপতি সিদ্দিকী বি.এ / অস্বীকার করিয়াছেন।’ দুই কলামের অপর সংবাদে ‘জে.এম.সেন হলে আওয়ামী লীগের মহিলা শাখার সভা/মহিলাদের প্রত্যক্ষ সংগ্রামে আগাইয়া আসার আহ্বান’। এক কলামে ‘সেনাবাহিনীর গুলি বর্ষণে/আহত সবির আহমদের ইন্তেকাল।’
১১ই মার্চ : প্রথম সংবাদ (৫ কলামের) ‘ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতির মোকাবেলায় শেখ মুজিবের ঘোষণা কোন শক্তিই বাংলার জনগণের চূড়ান্ত বিজয় প্রতিরোধ করিতে পারিবে না।’ দ্বিতীয় সংবাদ (৩ কলামের) : ‘পরিস্থিতির অবনতি রোধ কল্পে নয়া সামরিক আইন আদেশ জারী/সিলেটে সেনাবাহিনীর রসদ সংগ্রহে মারমুখী জনতার বাধাদান।’ দুই কলামের সংবাদ ‘শেখ মুজিবের বিঘোষিত কর্মসূচি মোতাবেক/প্রদেশ ব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত।’ এক কলামে ‘গণ আন্দোলনের প্রতি চট্টগ্রাম কলেজ অধ্যাপক সমিতির সমর্থন’।
১২ই মার্চ : প্রথম সংবাদ (৫ কলামের) ‘পূর্ব পাক আঃ লীগ সম্পাদক তাজউদ্দিনের বিবৃতি/বাংলার গণ আন্দোলন এক অভূর্তপূর্ব গতিলাভ করিয়াছে।’ দুইটি দুই কলামের সংবাদ-‘অসহযোগ আন্দোলনের দশম দিন যাবতীয় সরকারী অফিস আদালত তালাবদ্ধ ও সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শহরে/লাঠিধারী মহিলাদের তেজোদীপ্ত মিছিল।’
১৩ই মার্চ : প্রথম সংবাদ (৫ কলামের) ‘লাহোরে আসগর খানের বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা/ কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন একমাত্র কুর্মিটোলাতেই সীমাবদ্ধ রহিয়াছে’। সংবাদে বলা হয় – ‘লাহোর পৌঁছিয়া এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমন যদি আজ পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইতে চাহেন তাহা হইলে কোন শক্তিই তাহাকে প্রতিহত করিতে পারিবে না।’ দুই কলাম সংবাদে ‘সাহিত্যিক শিল্পীদের সভায় / চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের গণবিরোধী ভূমিকার নিন্দা।’ এক কলামের দুইটি সংবাদ ‘জাতীয় পরিষদ সদস্য/জহিরুদ্দিনের খেতাব বর্জন ও “শুন শুন / বংগবাস / ভূট্টোর বয়ান।’ ভূট্টোর বয়ানে বলা হয় পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জেড.এ. ভুট্টো আজ এখানে বলেন যে, ‘বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁহার দলের ভূমিকার যে অযৌক্তিক নয়, ইতিহাসই তাহা প্রমাণ করিবে।’
১৪ই মার্চ : প্রথম সংবাদ (৫ কলামের) ‘ঢাকায় ন্যাপ প্রদান ওয়ালীখান/শেখ মুজিবের চারি দফা শর্ত সম্পর্কে কাহারও কোন দ্বিমত থাকিতে পারে না।’ দ্বিতীয় সংবাদ (৩ কলামে) ‘শেখ মুজিবুর রহমান আহূত/অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের দ্বাদশ দিবস অতিবাহিত।’ দুই কলাম সংবাদে ‘নয়া সামরিক আইন প্রসঙ্গে শেখ মুজিব/ভয়ভীতি প্রদর্শনের মুখে জনগণ সংগ্রাম চালাইবে।’ এক কলামে ‘সামরিক কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা/চট্টগ্রাম হইতে খাদ্যবাহী জাহাজ ফেরত যায় নাই।’
১৫ই মার্চ : প্রথম সংবাদ (৫ কলামের) ‘সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে শেখ মুজিব/প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া ঢাকা আসিলে সাক্ষাৎ করিতে প্রস্তুত।’ দুই কলামের সংবাদ ‘চারিদফা শর্তে শেখ মুজিব আহূত/অসহযোগ আন্দোলনের ত্রয়োদশ দিবস অতিবাহিত’। এতে বলা হয় ‘আজ ঢাকায় বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধনে সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত আলোচনা ক্রমে গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর কল্পের স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান হয় বলিয়া ঢাকা প্রতিনিধি প্রেরিত সংবাদ প্রকাশ’। এক কলামের সংবাদ ‘আন্দোলনে আহতদের মধ্যে হাসপাতালে আরও একজনের মৃত্যু।’ দুই কলাম সংবাদে– ‘সামরিক আইনের নিকট নতি স্বীকার করিবেন না। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান এতে বলেন সামরিক আইনের নিকট মাথা নতি স্বীকার না করার জন্য দেশের সকল মানুষ ঐক্যবদ্ধ। শেখ মুজিব বলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা নিভিয়ে যাইবে না। …জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম আগাইয়া চলিয়াছে। বিশ্বে যাহারা স্বাধীনতা কামী এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করিতেছেন আমাদের সংগ্রামকে তাহারা নিজেদেরই সংগ্রাম হিসাবে গ্রহণ করিবেন।’
১৬ই মার্চ : প্রথম সংবাদ (৫ কলামের) ‘কর্মচ্যুতি ও কোর্ট মার্শালের ভীতি প্রদর্শন স্বত্বেও / সামরিক প্রতিষ্ঠানের এগারশত বেসামরিক কর্মচারী কাজে যোগদান করে নাই।’ দ্বিতীয় সংবাদ (২ কলাম) ‘বিমান বন্দরে কেবল টিক্কা খান গং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমন।’ দুই কলামের অপর দুটি সংবাদ ‘প্রবীণ রাজনৈতিক আবুল হাশিমের বিবৃতি/ভূট্টোর পরামর্শ মত চলিলে পাকিস্তানের বিভক্তি অবধারিত। লালদিঘীর জনসভায় কথাশিল্পী আবুল ফজল/বঞ্চিত বাঙালিরা আজ স্থির লক্ষ্যে আগাইয়া চলিয়াছে। জনাব আবুল হাশিমের বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের অন্যতম প্রবীণ রাজনীতিবিদ জনাব আবুল হাশেম আজ এখানে বলেন যে, জেনারেল ইয়াহিয়া যদি ভুট্টোর পরামর্শ মত চলে তাহা হইলে পাকিস্তানের বিভক্তি অবধারিত। … তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ প্রধানের চার দফা দাবী সংসদীয় গণতন্ত্রের সুপ্রতিষ্ঠিত পদ্ধতির সহিত সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। লালদিঘির জনসভার বিবরণীতে গতকল্য অপরাহ্নে লালদিঘীর ময়দানে চট্টগ্রামের সাহিত্যিক শিল্পী ও সংস্কৃতি সেবীদের উদ্যোগে আয়োজিত বিশিষ্ট কথাশিল্পী অধ্যাপক আবুল ফজলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও অধ্যাপক আবু জাফর, চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ সহ জনাব হাবিবুর রহমান, জনাব সবিউল আলম, সিইউজের সম্পাদক জনাব নুরুল আলম, জনাব মাহবুবুল হক ও জনাব আবদুর রব প্রমুখ বক্ততা করেন।’ এক কলাম সংবাদে ‘এনএসসি অংশীদারদের দাবী/সৈন্য প্রেরণে কোন জাহাজ দিবেন না।’
১৭ই মার্চ : প্রথম সংবাদ (ব্যানার হেডলাইন) – ‘প্রেসিডেন্ট ভবনে রুদ্বদার কক্ষে ইয়াহিয়া মুজিব আলোচনা শুরু / আজ ২য় দফা বৈঠক।’ দুই কলাম সংবাদে ‘ঢাকা হাইকোর্ট বার সমিতির সভায় গণ আন্দোলনের সহিত পূর্ণসংহতি ঘোষণা’। এতে বলা হয় – সভায় আইনজীবীগণ অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করিয়াছেন। এক কলাম সংবাদ–গহিরা জিন্নাহ পাঠাগারের নাম পরিবর্তন – এতে বলা হয় গত রবিবার রাউজান থানার গহিরার জিন্নাহ পাবলিক রিডিং রুম এন্ড ক্লাবের সভাপতি জনাব এ কে এম আবু বকর চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মাসিক সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সংগঠনের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে। ৪র্থ পৃষ্ঠায় দুইটি ২ কলাম সংবাদ – ‘ঢাকায় ছাত্রীদের আপোষ বিরোধী মিছিল / অসহযোগ আন্দোলনের ১৫শ দিবস অতিবাহিত ও সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে ওয়ালী খান পশ্চিম পাকিস্তান বলিয়া কিছুর অস্তিত্ব নাই।’ এক কলাম সংবাদ – ‘শেখ মুজিব সকাশে / ফজলুল কাদের’। (চলবে)
লেখক : জীবন সদস্য, বাংলা একাডেমি; সভাপতি (১৯৭২–৯০)-শেখ মুজিব গণ পাঠাগার (গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম) ও কলামিস্ট।