কেউ কারে নাহি জিনে
এইমাত্র চোখে পড়া ঘরটিতে কি কাজ হয় জানি না যদিও , তারপরও কেন জানি মনে হল যে, ওটা টিকিট ঘরই। মানে ঐ শহরমুখী বাসের টিকিট বিক্রি হয় এই ঘরে। অভ্যন্তরীণ লাউঞ্জের যে গেইটটি দিয়ে এ পর্যন্ত তিন তিন বার পা রাখলাম এই হিমচ্যানেলে, সেই গেটের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘরটি। আর সেই পিঠটিতে লাগানো আছে ছোট্ট দুটি জানালা, যেগুলোর পাল্লাগুলো আঁটসাঁটভাবে বন্ধ রাখা আছে এ মুহূর্তে, বাইরের হিমঝাপটা থেকে ভেতরের লোকজনদের রক্ষা করার মতো খুবই সংগত কারণে।
এদিকে এখানকার তুমুল এই ঠাণ্ডার পুরোপুরি উপযোগী না হলেও,এ মুহূর্তে গায়ে যা গরম কাপড় চড়ানো হয়েছে , তাতেই নিজেকে একটা চলমান কাপড়ের বস্তা মনে হচ্ছে। একটু আগের অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছি, হিমচ্যানেলের হিমের কাছে আমার গায়ের জামাকাপড় নস্যিসম। অনায়াসেই সে বসাবে তার তীক্ষ্ণ দাঁত শরীরে আমার, আর এখানে অহেতুক দাঁড়িয়ে থাকা মানে তার জন্য সে সুযোগ অবারিত করা। অতএব বেশ দ্রুত পা চালিয়ে রাস্তা পেরিয়ে, সেই ঘরটিকে পেছনে রেখে সামনে এসে দাঁড়াতেই, ব্যাগ সুটকেসশোভিত আরো জনা দশ বারো যাত্রির দেখা পেলাম। তাদের কয়েকজনকে দেখলাম নিজ নিজ হাতে ধরা সাদা একটা কাগজ দেখে, ইতিমধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বাসগুলোর একটার দিকে এগিয়ে যেতে। এতে অনেকটা যন্ত্রচালিতের মতো পেছন ফিরে ঐ ঘরটির দিকে চোখ ফেলতেই, নজরে এলো লোহার জালঢাকা অর্ধবৃত্তাকার জানালাটির দিকে, থাকে যেমন আমাদের দেশেরও নানান জায়গার টিকিট বিক্রির ঘরে। যার ওপারেই বসে থাকে টিকিটবাবু বা টিকিট ইস্যু করার লোক ।
টিকিটঘর এই শব্দদ্বয় যখনই মনে পড়ে, তখনই চোখে ভেসে উঠে, বালকবেলায়, কিশোরকালে, কুমিল্লা, চাঁদপুর আর চট্টগ্রাম শহরের সিনেমা হলগুলোর টিকিট ঘরের সামনে লাইন ফাইনের মোটেই তোয়াক্কা না করে ধাক্কাধাক্কি করতে থাকা নানান বয়সী মানুষের ধুন্দুমার জটলার ছবি! যে জটলা পেরিয়ে একটি টিকিট যোগাড় করতে পারা, সবসময়ই আমার কাছে গল্পে পড়া সাপের মাথা থেকে মনি আনার মতোই দুঃসাধ্য ব্যাপার মনে হতো। ফলে রোগা দুবলা আমি অতো ঝুকি না নিয়ে, ক্ষেত্রভেদে দু, তিন, পাঁচগুন বেশি দামি টিকিট কিনতাম কালোবাজারিদের কাছ থেকে। সংগত কারণেই বহুকাল আর সিনেমায় যাই না। কিন্তু তারপরও একই দৃশ্য আজো দেখি দেশে, ঈদে পার্বণে ট্রেন বাস কিম্বা লঞ্চ টার্মিনালের টিকিট ঘরের সামনে। এ মুহূর্তে মনের চোখে বদ্ধমূল হয়ে থাকা সেই টিকিট ঘরের দৃশ্যের সাথে, এখানকার টিকিট ঘরের দৃশ্য একেবারেই না মেলাতে স্বস্তি পেলাম ভীষণ। টিকিট ঘরটির সামনে একজনই যাত্রীকে টিকিট কাটতে দেখলাম।
ঐদিকে এগুতে এগুতে ভাবলাম, এই মুহূর্তে আকারের তুলনায় অত্যন্ত জনবিরল, বেইজিং এর এই বিমানবন্দরের বাস টার্মিনালের টিকিট ঘরের সামনে ঐ রকম ভিড় থাকাটা মোটেই যৌক্তিক নয়। তারপরও কেন মনের চোখের সামনে হুলস্থুল জটলার টিকিট কাউন্টারের ছবিই ভেসে উঠলো?
এরইমধ্যে টিকিট কাউন্টারের সামনের সিমেন্টের পাটাতনে কনুই রেখে কিছুটা নিচু হয়ে ভেতরের দিকে সামনে তাকিয়ে, ওখানকার নির্লোম মুখ আর কেশবিরল মাথা আর কপালের নীচে পিটপিট করতে থাকা চায়না মাপের চোখগুলোর দিকে চোখ পড়তেই , হড়বড় করে ইংরেজিতে বললাম -পনের নম্বর বাসের জন্য আমার পাঁচটা টিকিট দরকার ?
কথা ক’টি বলার পর, গাঢ় নীল রঙয়ের জবরজং জ্যাকেটের উপর বসানো ভাবলেসহীন মুখটির দিকে তাকিয়ে তার বয়স আন্দাজ না করতে পারলেও কুঁচকে যাওয়া মুখের চামড়া দেখে মনে হলো, ষাটের কাছাকাছি হবে এই লোকের বয়স । তার মানে তো হল এর সাথে ইংরেজি বলা, আর বাংলা, আরবি বা হিব্রু বলা একই কথা।
নিজেকে শুধরে, তড়িঘড়ি করে তাই হাতে ধরা সেই ভ্রমণ ফাইলটি খুলে রিজেন্ট হোটেলের ছবিটি দেখানোর সাথে , হাতের পাঁচ আঙুল ছড়িয়ে ইশারায় বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, ঐখানে যাওয়ার জন্য পাঁচটা টিকিট দরকার। মাথা একটু এগিয়ে ছবিটির দিকে তাকিয়ে আবারো পিটপিট করলো টিকিটওয়ালা চোখে চোখ রেখে।
তুমুল হতাশায় বুঝলাম কিছুই বোঝাতে পারিনি তাকে। এবার টিকিট ঘরের ডান দিকের কোনায় আমাদের পনের নম্বর বাসটি দাঁড়ানোর খালি জায়গাটি দেখিয়ে আবারো বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে ঐ বাসটির টিকিট দরকার আমার পাঁচটি। যদিও টিকিট ঘরের ভেতর থেকে বাসস্ট্যান্ডের ঐ অংশটি দৃশ্যমান না জানি, তারপরও ডুবন্ত লোকের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টার মতোই করলাম সে চেষ্টা। মনে মনে নিজের চুল ছিড়ছি, কানমিং এর হোটেলের ম্যানেজারকে দিয়ে, কেন যে এই ভ্রমণ ফাইলটাতে বেইজিং রিজেন্ট হোটেলের ঠিকানা চায়নিজে লিখে রাখলাম না? তা হলে তো এখন একে সহজেই বোঝাতে পারতাম! এ কারণে নিজেকে যখন ঝেড়ে গালি দিচ্ছি মনে মনে, কোত্থেকে যেন এসে পাশে দাঁড়ালো একই রঙয়ের জবর জং টুপি জ্যাকেট বুট পরা আরেকজন তখন।
ঘাড় ফিরিয়ে তার চোখে চোখ পড়তেই টিকিট কাউন্টার থেকে কনুই তুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, দেখালাম তাকে ফাইলেবন্দি রিজেন্ট হোটেলের ছবি। অতঃপর ডান তর্জনীতে ১৫ নম্বর বাস দাঁড়ানোর খালি জায়গাটি নির্দিষ্ট করে দেখানোর সাথে সাথে, তাকেও হাতের পাঁচ আঙুল ছড়িয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে আমার পাঁচটা টিকিট দরকার।
বিনাবাক্যব্যয়ে এ মূর্তি হাত থেকে ফাইলটি নিয়ে, মনোযোগ দিয়ে দেখে নিচু হয়ে কাউন্টারের ভেতরের জন কে চুং চাং করে কিছু একটা বললেন। তাতেই বেশ আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হলেও সচল হয়ে উঠেছে তার হাতের আঙুল, কাউন্টারের নীচের দিকে রাখা কম্পিউটারের কি বোর্ডের উপর। হ্যাঁ ভেতরে বসে থাকা টিকিটবাবুটির কম্পিউটারের কি বোর্ড চালানোর দক্ষতা, আমাদের দেশের বছর বিশেক আগের এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন পুলিশদের মতোই। তখন সবেমাত্র ঢাকা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন কাউন্টারে কম্পিউটার বসানো হয়েছিল। ডিউটিতে থাকা ইমিগ্রেশনপুলিশের কর্মীরা, পাসপোর্ট ভিসা দেখার পর, যাত্রীর নাম কম্পিউটারের মগজে ঢোকাতে গিয়ে, নির্দিষ্ট অক্ষরের সন্ধানে তাদের আঙুল যেরকম অনিশ্চিতভাবে কি বোর্ড সমুদ্রে হাবুডুবু খেত,এখানকার টিকিটবাবুটির ততোটা হাবুডুবু অবস্থা না হলেও, মোটামুটি কাছাকাছি হবেই।
এরইমধ্যে কাউন্টারের ভেতর থেকে কড় কড় কড়ড় কড়ড় শব্দ হতেই বুঝলাম প্রিন্ট হচ্ছে আমাদের টিকিট। মনে মনে কায়মনে প্রার্থনা করছি , আর কিছু না হোক অন্তত বাসের নম্বরটি যাতে তাতে ইংরেজিতে লেখা থাকে। আর না হয় ঐ চায়নিজ টিকিট নিয়ে কোন বিভ্রাটে যে পড়ি আবার তার তো কোন ঠিক ঠিকানা নেই।“ওয়ান হান্দ্রেদ তুয়েন্তি পাইব” পাশ থেকে শব্দ আসতেই তাকালাম একটু আগে এসে পাশে দাঁড়ানো মুশকিল আসানকারী চায়নাম্যানের দিকে।
মিট মিট হাসতে থাকা তার পিট পিট করা চায়নিজ চোখে চোখ পড়তেই মুখেও মুচকি হেসে মাথা ঝোকাল সে । হেসে আমিও মাথা ঝুকিয়ে ,ফের প্রথমে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ১৫ নম্বর বাস দাঁড়ানোর জায়গাটি দেখিয়ে, হাতের পাঁচ আঙুল ছড়িয়ে ইশারায় আবারো নিশ্চিত করতে চাইলাম যে, আমার কিন্তু ঐ বাসের পাঁচটা টিকিট দরকার।
“ইয়েস ইয়েস” বলে হাসিমুখে বেশ নিশ্চয়তাসুলভ জবাব দিয়ে, ইশারায় সামনের কাউন্টারের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সে। ওদিকে চোখ ফেলতেই, আধাপৃষ্ঠা আকারের দুপাশের মার্জিনে লাইন ধরে থাকা ফুটা সমৃদ্ধ টিকিটটি দেখতে পেয়েই দ্রুত ঐটি হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরে আবারো ছাড়লাম হাঁফ।
টিকিট নামের এই গোটা কাগজটি চায়নিজে লেখায় ভরপুর হলেও, তার মধ্যে বাসের নম্বরটি ঠিকই লেখা আছে ইংরেজিতে। আর তাতেই মন বাক বাকুম আনন্দে নৃত্য শুরু করতেই, টিকিটের দাম ইংরেজিতে লেখা আছে কি না , তা আর না খুঁজে মানি ব্যাগ থেকে ৫০ রেন মেন বির তিনটা নোট বের করে পাচার করে দিলাম টিকিট কাউন্টারের ওপাশে ।
নোটগুলো হাতে পেতেই দেখলাম পুনরাবৃত্তি হলো এখানেও কানমিং দৃশ্যের। মানে হাতের আঙ্গুল দিয়ে বেশ করে টিপে ঘসে পরীক্ষা করছেন টিকিটবাবু প্রতিটি নোট, আসল না কি নকল? যার মানে হল এই যে, জাল নোটের দৌরাত্মে কানমিং আর বেইজিং এর অবস্থা হলো সম্ভবত “কেউ কারে নাহি জিনে সমানে সমান”।
টিকিটওলা যখন আমার দেয়া নোটগুলো আসল না নকল তা পরীক্ষা করায় ব্যস্ত, আমি তখন টিকিটটা আমার মুশকিল আসানকারীর হাতে দিয়ে, ভ্রমণ ফাইলের রিজেন্ট হোটেলের বুকিং এর পাতাটি দেখিয়ে ফের নিশ্চিত হতে চাইলাম যে, সঠিক টিকিট পেয়েছি কি না আমি। ফের বেশ নিশ্চিত হাসি হেসে টিকিটটি হাতে তুলে দিয়ে, মুখে “ইয়েস ইয়েস ওকে ওকে” বলে আবারো টিকিট কাউন্টারের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করায়, ঐদিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ভেতর থেকে ফেরত দেয়া হয়েছে ২৫ রেন মেন বি।
ফিরতি রেন মেন বি গুলো হাতে নিতে নিতে, একটু আগে আমার মুশকিল আসানকারি বাহলুল মজনুকে একগাল হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে, একবার ভাবলাম দেবো নাকি টিপস এই পুরো টাকাটাই তাকে? হ্যাঁ একটু আগে হাতে পাওয়া বাসের টিকিটটিকে, এই মুহূর্তে, স্কুলের বইয়ের গল্পে খলিফা হারুন রশিদের স্ত্রীর, বাহলুল মজনুর কাছ থেকে লাখ টাকায় কেনা বেহেস্তি টিকিটই মনে হচ্ছে। গল্পে পাগলা বাহলুল লাখ টাকা নিয়েছিল বেগম সাহেবার কাছ থেকে, হিজিবিজি আঁকা টিকিট নামের কাগজটির বিনিময়ে, এখানে তো আমি দিচ্ছি বাংলা টাকায় সাড়ে তিনশ বা চারশ টাকা !
কিন্তু নাহ! ঐ যে বললাম মাত্র দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া বিদেশে টিপস দিতে গিয়ে সবসময় আমি ভুগি নানা দ্বিধায়, এখানেও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল সেই দ্বিধাটি। বিশেষত টিকিট ঘরের ভেতরের আর বাইরের নীল জ্যাকেট পরিহিত দুজনকে সরকারী কর্মচারী মনে হওয়াতে সে দ্বিধাটি এখন এক্কেবারে অপরাধবোধ হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। হালে যতই পুঁজিবাদী পথে হাঁটা শুরু করুক না কেন চায়না, আজো সম্ভবত এখানে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসে আছে মাওয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কর্মীরা না হলেও তাদের ঘোরতর সমর্থকেরাই। আর তারা তো ঘুষ দেয়া আর নেয়াটাকে অত্যন্ত কড়া শাস্তিযোগ্য গর্হিত অপরাধ হিসাবেই বিশ্বাস করার কথা। নাহ, খুশি হয়ে বকশিস দিতে গিয়ে এই মুহূর্তে উটকো কোন ঝামেলায় পড়তে চাই না আর। অতএব একগাল হেসে আবারো তাদের দুজনকে ধন্যবাদ জানিয়ে ধরলাম ফিরতি হাঁটা হিমচ্যানেলের ওপারের লাউঞ্জের উষ্ণতার দিকে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক