পেশাদারিত্ব ও হৃদয়দারিত্ব
হোটেলে ঢোকার মুখেই লাজু হেলেনকে থামিয়ে উদ্বিগ্ন চেহারায় খোঁজ খবর নেবার মিস রিনার এই প্রচেষ্টাটিতে তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের চেষ্টার চেয়েও আন্তরিকতাটাই মুখ্য মনে হল। ফলে আমিও তাকে যাকে বলে এক্কেবারে অন্তরের অন্তস্থল ধন্যবাদ দিতে দিতে সাথে সহাস্যে জানালাম, পথ হারিয়ে আজ যে মুশকিলে পড়েছিলাম, তাতে তার উপরই ছিল আমার যাবতীয় ভরসা। আর সে দায়িত্ব সে পালন করেছে অতি অবশ্যই চমৎকারভাবে।
আমার কথায় মনে হল কিছুটা বুঝি ধাতস্ত হলেন আমাদের ত্রাণকর্ত্রী। তাতে এও মনে পড়ল যে এই হোটেলটিতে অনলাইনে বুকিং দেয়ার সময় যতোটুকু ঘাটাঘাটি করেছিলাম তখন অনেকেই দেখেছিলাম, হোটেলের ফ্রন্টডেস্কের এক নারীকর্মীর ভূয়সী প্রশংসা করতে। তবে কি এই মিস রিনাই সেই কর্মী? ভাবতে ভাবতে তাকে জানালাম।
আমরা কিন্তু আজ আর কোথাও বেরুবো না। অতএব গাড়ি চলে যেতে পারে। তবে আজ খুব ইচ্ছা ছিল তোমাদের পাখির বাসা মানে অলিম্পিক স্টেডিয়াম দেখার। কিন্তু তা তো আর হচ্ছে না। দলের সবার যে বেড়াছেড়া অবস্থা। থাক, কী আর করা? কপাল খারাপ? তবে কাল সকাল সকাল বেরুবো। তবে যাবো কাল গ্রেট ওয়াল দেখতে, এর সাথে আর কী দেখা যায় বলোতো?
অসাবধানতাবশত ফের নিজের স্বভাবগত দ্রুতলয়ে এতগুলো কথা একসাথে বলে যে ভুল করলাম, পড়তে পারলাম তা মিস রিনার চেহারা সাথে সাথেই। পুরো কথাগুলো তার হৃদয়ঙ্গম হলো কি না বুঝতে পারছি না। বেশ কিছুক্ষণ থমকে থেকে আমার কথাগুলো সম্ভবত হজম করার চেষ্টা করে সে মুখ খুলতেই পরিষ্কার হল যে আর কিছু না হোক, আজ যে গাড়ি আর লাগবে না তা সে বুঝেছে। আর বুঝেছে যে আগামীকাল একটু সকাল সকাল বেরুতে চাই, গ্রেট ওয়াল দেখতে যেতে।
শোন, খুব সকালে রওয়ানা করার দরকার নেই। যদিও বেশ খানিকটা দূরেই গ্রেট ওয়াল তবে এই ধরো সাড়ে আট টা বা ন’টায় রওয়ানা করলেই চলবে। আশ্বাস দিলেন মিস রিনা স্বভাবগত উঁচু গলার চুং চাং ঝঙ্কারের চিংলিশে।
আচ্ছা, এখন কি ভাড়া মিটিয়ে দিতে হবে নাকি লি খাঁকে? মিস রিনাকে করা এই প্রশ্নের পিঠে শোনা গেল লাজুর গলা ‘আমরা তা হলে রুমে যাই। তুমি ভাড়াটারা মিটিয়ে আসো। দীপ্র, অভ্র চলো আমরা লিফট ধরতে যাই’। খাঁটি বাংলায় কথাগুলো বলেই মিস রিনাকে একটা বিদায়ি হাসি দিয়ে দলবল নিয়ে লাজু লিফটের দিকে রওয়ানা করতেই বললাম।
ঠিক আছে, যাও তোমরা। আসছি আমি আগামীকালের ব্যাপারে কথাবার্তা পাকা করে। ওরা চলে যেতেই মিস রিনার দিকে তাকিয়ে বোঝা গেল বেচারি ভির্মি খেয়ে গেছে আবারও আমার বাংলা টোনের ইংলিশের পিঠাপিঠি লাজুর আমার খাস বাংলা কথপোকথনে। বেচারি হাঁসফাঁস করে হাতড়াচ্ছে বাতাসে, একটু আগে আমাদের দুজনের মুখ থেকে পরপর নির্গত হওয়া শব্দ আর ধ্বনি সমূহের ভিড়ে, যা তার কানে গেলেও পশেনি মরমে।
অতএব আর ভুল না করে বেশ ধীরে ধীরে একটা একটা শব্দ উচ্চারণ করে বললাম যে ড্রাইভার কে কি আজকের ভাড়া চুকিয়ে দিতে হবে এখন? নাকি আগামীকাল যেহেতু সেই হবে আমাদের গাড়ির চালক। না শুধু এই আমার বহুদিনের স্বপ্ন, মহাপ্রাচির অভিযানের পথ প্রদর্শকও, কাল তার ভাড়া এক সাথে মিটালে হবে কি?
‘ইয়েচ, ইয়েচ প্লিজ’
বুঝলাম না মিস রিনার এই ইয়েসের মানে কী? এক্ষুণি দিতে হবে ভাড়া তার জন্যই কি ইয়েস বলল, নাকি কাল দিলেও চলবে সেজন্য বললো।
নিজের বুঝটা পরিষ্কার করার জন্য এবার শুধু জিজ্ঞেস করলাম যে এক্ষুণি দিতে হবে কি না ভাড়া? তাতে ফের হ্যাঁ বোধক উত্তর পেতেই ঠিক আছে বলেই হোটেলের পিক আপ ড্রপ এলাকার দিকে ঘুরে হাঁটা দিতেই পিছু নিলেন মিস রিনাও।
হোটেলের মূল প্রবেশদ্বার বড় ঘূর্ণায়মান দরজাটি পেরিয়েই পেলাম লি খাঁকে, দাঁড়িয়ে আছে সে জ্যাকেটের পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে উদাস মুখে রাস্তার দিকে নজর ফেলে। এরই মধ্যে ঘূর্ণায়মান সেই মূলফটক লাগোয়া আরেকটা বাচ্চা দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসেছেন মিস রিনাও। বেরিয়েই নিজেদের মাতৃভাষায়, লি খাঁর উদ্দেশ্যে কিছু বলতেই সম্বিৎ ফিরে তাকালো সে আমাদের দিকে।
এগিয়ে গিয়ে আজকের সার্ভিসের জন্য তাকে ধন্যবাদ দিয়ে তার পাওনা হাতে তুলে দিতেই, আবছা এক চিলতে হাসি দেখা গেল লি খাঁর মুখে। সাথে মাথা নুইয়ে করল সে হালকা নড। ততোক্ষণে মিস রিনা তুবড়ি ছুটিয়েছে খাস চায়নিজের। তবে চায়নার কোন সে ডাইলেক্ট তা তো জানি না। জানলেই বা কি আমার কাছে তো যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন, মানে সবই হায়ারোগ্লিফিক বা হটেনটটদের বাতচিত।
মিস রিনার কথার তুবড়ির উত্তরে লি খাঁ মুখ খুলে সামান্য কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করতেই বুঝলাম, বেশী কথার মানুষ না সে। আর ভাষাবিভ্রাটের কারনে শুধু বিদেশীদের সাথেই যে তার এই স্পিকটি নট স্বভাব, তাও না। স্বভাবগত ভাবেই সে কম কথার মানুষ। এছাড়া যতোটুকুই বোঝা গেছে আজকের দিনের এই অল্প সময়ে, তাতে এও পরিষ্কার যে কাজের মানুষ সে।
“শোন আগামীকাল সকাল ঠিক সাড়ে আটটায় গাড়ী নিয়ে এখানে মজুদ থাকবে সে। বলে দিয়েছি তা ভাল করে।“ মিস রিনার কাছ থেকে এই নিশ্চয়তা পেতেই, দুজনকেই ফের ধন্যবাদ দিয়ে ঘুরে হাঁটা ধরলাম হোটেলের ভেতরে দিকে।
লিফটের গোড়ায় এসে বোতাম টিপে দিয়ে অপেক্ষা করতে করতে মনে হল, মিস রিনা যে একজন চোস্ত ও ধারালো পেশাদার হোটেল কর্মী তাতে কোন সন্দেহ নাই ! তবে পেশাদারিত্বের সাথে যখন কারো হৃদয়দারিত্ব যোগ হয়, তখন তার কাজে যোগ হয় একটি অপ্রতিহত ভিন্নমাত্রা, যা তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, যাবেই সামনে অনেককে পিছু ফেলে । উঠবেই যে সে উপরে তরতর করে সফলতার সিঁড়ি বেয়ে, সন্দেহ নেই যে তাতে কোন, বলতে পারি তা নিজের এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে। আর এই হৃদয়দারিত্ব ব্যাপারটা মাপার কোন যন্ত্র বা উপায় নাই। তবে তা অবশ্যই টের পাওয়া যায় ! পেলাম যা একটু আগেই, আর তাতে কি হল?
এর মধ্যে লিফট এসে সামনে হাজিরা দিতেই তাতে চড়ে, পেশাদারিত্বের সাথে হৃদয়দারিত্বের সমসত্ব মিশ্রনে কি ফলাফল হয় তা ভাবতেই, মনে হল এই যে, যে আমি ভেবেছিলাম এতো কাছের তিয়েন আন মেন স্কয়ারে যাওয়ার জন্য মিস রিনা অহেতুক একটা আক্রা দামের গাড়ী গছিয়ে দিয়েছিল আমাদের। তাতে বেশ একটা অসন্তোষ গুঁজ গুঁজ করছিল মনে। ফলে সেই অসন্তোষটি তাকে শোনানর জন্য বদ্ধপরিকরও ছিলাম ফিরে এসে তার সাথে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত। কিন্ত দেখা হওয়ার পর তার ঐ হৃদয়দারিত্বের দখিনা হাওয়ার তোড়ে কোথায় যে ভেসে গেল আমার সেই অসন্তোষ আর অনুযোগ টেরই পেলাম না এক্কেবারে ! এতেই হৃদয়দারিত্ব উড়িয়ে দিল তার বিজয় পাতাকা !
সে যাক রুমে ফিরে দেখি লাজু ধীরেসুস্থে নিজেকে ধড়াচূড়ামুক্ত করতে করতে জোর তাড়া দিচ্ছে, রুমে ঢুকেই রেস্ট রুমের দখল নেয়া অভ্রকে। মায়ের এই তাড়াকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না যে অভ্র বোঝা যাচ্ছে তা, ভেতর থেকে ক্ষীণভাবে নানান লয়ে আসা পানি পড়ার শব্দে। এমনিতেই চমৎকার ওম ওম গরম এই কক্ষ। পুত্রের এই খেয়ালি ছেলেমির কারণে যাতে ঘরের উত্তাপ আবার হঠাৎ করে অসহনীয় ভাবে বেড়ে না যায়, তা নিশ্চিত করার জন্য মোলায়েমভাবে ওকে দ্রুত বাথরুমের দখলিস্বত্ব ছাড়ার অনুরোধ করে, নিজেও ধড়াচূড়ামুক্ত হয়ে, গা এলিয়ে দিলাম সোফায়। ঘরে ঢোকার পর পরই কেন না জানি রাজ্যের ক্লান্তি ভর করেছে সমস্ত শরীরে ও অস্তিত্বজুড়ে।
‘কী ব্যাপার? বাইরে থেকে এসে হাত মুখ না ধুয়ে, গোসল না করেই যে শুয়ে পড়লে’!
মানে যা ভেবেছিলাম মনে মনে, এইমাত্র অনিবার্য সেই কারণ দর্শানো নোটিস জারী হলেও বেশ সাহসের সাথেই তা উপেক্ষা করলাম। কপাল ভাল যে বিছানায় শুয়ে পড়িনি। তাতেই রক্ষা পেল আমার উপেক্ষাটি। তারপর আরো ঝুঁকি নেবার সাহস না থাকায় মিন মিন করে বললাম, খুব টায়ার্ড লাগছে। তাই একটু গড়িয়ে নিচ্ছি তাও এই সোফায়। বিছানার পবিত্রতা আর পেলবতাতো নষ্ট করিনি। আর বাথরুমের সিরিয়াল তো আমার আসবে অনেক পরে। ততোক্ষণে যতোটুকু পারা যায় একটু ঝিমিয়ে নেই এইখানে।
এরই মধ্যে রুমের উত্তাপ আর না বাড়িয়ে একটু আগের আমার মোলায়েম আবেদনে সাড়া দিয়ে অভ্র বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেই পড়েছে মায়ের হাতে! কারণ গোসল না করে শুধু প্রাকৃতিক কর্মের সাথে একটু জল ঘাটাঘাটির খেলা সাঙ্গ করে সে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু তা তো মানার কথা নয় মায়ের। অতএব তাকে দলাই মলাই করে গোসল করানোর জন্য, মা তাকে নিয়ে ঢুকল ফের সেই বাথরুমেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক