তাওইজম, মাওইজম
আরে ঠিক আছে, ভুল যদি হয়েই থাকে এবার, হোক না তা। একবার এসেই কি সব দেখে ফেলা যায় নাকি কোন জায়গার? নিজের দেশেরই কি সব কিছু দেখতে পেরেছ না কি এখন পর্যন্ত? মুখ খুলল এসময় মনের ভেতরের দ্বিতীয়জন।
আবার আসিব ফিরে, সেই লালমাটির প্রান্তরে, দেখিতে দিগন্তজোড়া বিষণ্ণ জমির বুকের লালের লালিমা, জীবনানন্দ কে প্যারোডি করে দ্বিতীয়জনের মন্তব্যের উত্তরে আওড়াল প্রথমজন ।
যাক কুনমিং মালভূমির লাল্ভূমি নিয়ে নিজের ভেতরের দু’জন যে অবশেষে বরাবরের মত ঝগড়া ফ্যাসাদ শুরু করেনি, তাতে বরং বেঁচেই গেলাম। ফলে ভাবলাম এখনাটায় যেহেতু সেই লালভূমির দৃশ্যের শিল্পকর্ম ঝুলছে দেয়ালজুড়ে , তাহলে নিশ্চয়ই আশেপাশে আছে কোথাও কুনমিং কক্ষ।
নাহ এদিক ওদিক বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করেও দেখা পেলাম না এখানে কুনমিং কক্ষের। এদিকে সেই লালমাটির ছবি দেখার পর থেকেই মনের ভেতরে কেউ, গুন গুন করে ঐ গানটা গাইতে শুরু করেছে “লাল পাহাড়ির দেশে যে, রাঙামাটির দেশে যা’
কিন্তু তারপর যে কী আছে গানটায়? মনে করতে পারছি না! তবে গানের সাথের বাজনাটা ঠিকই বাজছে কানে। বেশ কিছুক্ষণ পরের লাইন গুলো মনে করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে, এবার মন গাইতে শুরু করলো ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গা মাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে। ওরে কার পানে মন হাত বাড়িয়ে, লুটিয়ে যায় ধুলায় রে, আমার মন ভুলায় রে।’
তবে আমাদের দেশে যে মাটিকে লালমাটি বলে ঐ সব গান বেঁধেছেন কবিরা, তারচেয়ে ঢের বেশী লাল ছবিতে দেখা, ঐ মাটির রং। এমনকি কুমিল্লায় আমাদের বাসা থেকে ১৫ / ২০ মাইল দূরে লালমাই নামের যে পাহাড় ছিল বা এখনও আছে, সেই পাহাড়ের মাটির রংও এরকম লালা না। এ লাল হল এক্কেবারে রক্ত লাল। দেখে বিশ্বাস হতে চায় না যে মাটির রং এমন লালও হতে পারে! আচ্ছা এ চায়নার কবিরা, গীতিকারেরা এই লালমাটি নিয়ে কোন গান বা কবিতা লিখেছেন কি , আমাদের মত? করার তো কথাই। স্টোন ফরেস্টের পাথুরে বন নিয়ে যদি চায়নিজ কবি, কবিতা লিখতে পারেন, সে জায়গায় এই লাল মাটি তো অনেক নরম সরম ব্যাপার। কবিদের মন যেহেতু নরম হয়, তাদের তো এ নিয়ে কবিতা লেখারই কথা। অবশ্য নিশ্চিত ভাবে এরকম মনে করাটাও ঠিক না। কবিদের মন কখন যে কি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তার তো কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। এই যেমন লালমাই পাহাড়ের কাছাকাছি বহুদিন থাকার পরও তো সে পাহাড়ের লালমাটি নিয়ে কোন কবিতা বা গান কাউকে আবৃত্তি করতে বা গাইতে শুনিনি তো।
“বাবা, বাবা ঐ যে ওখানে একটা রুমের দরজা খোলা দেখা যাচ্ছে।’ বলেই দীপ্র নিজেই সেদিকে হাঁটা শুরু করতেই সবাই ওকে অনুসরণ করে গিয়ে হাজির হলাম এক হিমু ঘরের সামনে!
হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন, হিমু! মানে হুমায়ুন আহমদের বিখ্যাত চরিত্র হিমু , যার ভক্তের কী না অভাব নাই আমাদের কিশোরী কিশোর আর তরুণী তরুণদের মাঝে। আচ্ছা হুমায়ুন আহমেদ নিজেকেই কি হিমু ভাবতেন নাকি মনে মনে ? ব্যাপারটা এতোদিন খেয়াল না করলেও এই এখন, গ্রেট হলের এই হলুদ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে, হুমায়ুন আর হিমু নামের মধ্যে কী না একটা যোগসূত্র খুঁজে পেলাম! বাহ বেশ মজার তো ব্যাপারটা!
গ্রেট হলের এই সভাকক্ষটি হল সাংহাইয়ের জন্য বরাদ্দ।এই কক্ষের ছাদজুড়ে ঝুলতে থাকা ঝাড়বাতির মোহন ক্রিস্টালগুলো ছাড়া, এর কার্পেট, দেয়াল, সোফার কভার সবকিছুতেই নানান শেডের হলুদের ছোঁয়া আছে। এ পর্যন্ত দেখা দেয়ালে সাঁটানো নানান চিত্রকর্মের মধ্যে এটি ব্যতিক্রম । যার কারণেই এটিকে এতোদূর থেকে ছবিই মনে হচ্ছে। অন্যান্য ছবিগুলোর বিষয় বস্তু প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী হলেও এই ছবির দৃশ্য নাগরিক । মানে বিশাল বিশাল স্কাইস্ক্র্যাপার আর চওড়া সড়ক নাকি যেন ফ্লাইওভার সমৃদ্ধ এই ছবি, ধারন করেছে আধুনিক সাংহাই নগরকে ।
কক্ষের মাঝখানে অর্ধ বৃত্তাকারে সাজানো আছে হালকা ঘিয়ে রঙয়ের , মানে ঐ সেই হলুদেরই হালকা শেডের র্যাক্সিনে নাকি চামড়ায় মোড়ানো গুনে গুনে মোট পনেরটা বড় সাইজের সোফা। এর মানে কি? সাংহাই পরিচালনাকারী চায়নিজ কম্যুনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য সংখ্যা কি পনেরজন নাকি? অবশ্য এই অর্ধবৃত্তের দু পাশের পরিধির দিকে, রুমের মাঝখানের সোফাগুলোর পেছনে বসানো আছে আরো কিছু হাতলঅলা মোটাগদি সমৃদ্ধ চেয়ারও। ঐ চেয়ার গুলোর ধরণ ধারণে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ওগুলোতে যারা বসবেন তারাও গুরুত্বপূর্ণ, তবে সামনের সোফায় যারা বসেন তাদের পরের সারির গুরুত্বপূর্ণ জন এনারা।
এদিকে এই রুমেও ঢুকতে না পেরে, এতক্ষণ বাইরের ছবি তোলাতুলি করে, এখানে থেকে চলে যাবার জন্য সবাই যে উস্খুস করছিল, তা টের পাইনি। পেলাম টের এখন লাজুর তাড়ায়। অতএব আর বিলম্ব না করে সামনের দিকে হাঁটা দিতেই, ফের মনে পড়ল সেই হিমু আর হিমুর স্রস্টা হুমায়ুন আহমেদের কথা। ভাবলাম আচ্ছা এ কক্ষ কি দেখতে এসেছিলেন হুমায়ুন আহমেদ ? এসে থাকলে তো নিশ্চয় উনি হিমচ্যানেল পাড়ের হিমুঘর নামের একটা বই লিখে ফেলতেন, যা নাকি আবার হুড়মুড়িয়ে লাইন ধরে কিনতো তাবৎ হিমু আর হুমায়ুন প্রেমিকরা।
সে চিন্তার লেজ ধরে হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয় নাটক “কোথাও কেউ নেই” নাটকের বিখ্যাত চরিত্র বদির কথা মনে পড়তেই হাসি পেল। ভাবলাম নাটকের কোন দৃশ্য যদি এমন হতো যেখানে দেখা যেত যে বদি, চায়নায় হানিমুন করতে এসে এই গ্রেট হলের হলুদ ঘর দেখার পর ফিরে গিয়ে, বাকের ভাই আর মজনুকে এ রুমের বর্ণনা দিতে গিয়ে নিশ্চয় বলতো, “বুঝলেন বাকের ভাই সাংহাই রুমটা হইল এক্কেবারে টারমারিক কালারের রুম। মুনা আর আপনের বডি টারমারিক প্রোগ্রাম ওইখানে করতে পারলে ভেরি গুড হইত।”
“আচ্ছা আর কতোক্ষণ ঘোরাঘুরি করবে এখানে। এখানে আর কী দেখব আমরা? এখানে তো কোন রুমেই ঢুকতে দিচ্ছে না। দেখতে হচ্ছে সব বাইরে থেকে দরজায় উঁকি মেরে“ পাশ ভেসে আসা লাজুর জিজ্ঞাসার উত্তরে বললাম, নাহ আর বেশিক্ষন না। তবে এর মূল কনফারেন্স হলটা না দেখে গেলেতো হবে না। চল দেখি ওটা খোলা আছে কি না।
“কোনদিকে আছে ওটা” ?
তা তো জানি না। দাঁড়াও এখন থেকে আর উল্টাপাল্টা হাঁটবো না। ঐ যে পিতলের স্ট্যান্ডগুলোতে চায়নিজের সাথে ইংরেজিতেও লেখা আছে রুমগুলোর নাম, ঐ রকম নিশ্চয় গ্রেট হলের সেই গ্র্যান্ড কনফারেন্স রুম কোনদিকে আছে তাও লেখা থাকবে। সেগুলোর দিকে নজর রাখতে হবে এখন থেকে।
এবার হল ঘরের ইতিউতি ছড়িয়ে হাঁটাহাঁটি আর ছবি তোলাতুলিতে ব্যস্ত সবাইকে একাট্টা করে , শুরু হলো সাইনবোর্ড লক্ষ্য করে যাকে বলে পরিকল্পিত হাঁটাহাঁটি।
এতে শুরুতেই বাঁয়ে নজরে পড়ল, একদমই খাড়া নয় অনেকটাই ঢালু বা হেলান দিয়ে থাকা বিশাল চওড়া একটা সিঁড়ি উঠে গেছে উপরের দিকে। ওদিকে তাকাতেই সিঁড়িগুলো ডাকতে শুরু করল “আয়, আয়”। সে ডাকে সাথে সাথে সাড়া না দিয়ে বরং ভাবছি, বেশ অনেকটাই হাঁটতে হবে এই সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে গেলে। তবে সিঁড়ি গুলো যেহেতু খাড়া নয়, এগুলো ভেঙ্গে উঠতে তেমন কোন কষ্ট হবে না। তারপরও লাজুর পায়রে অবস্থা বিবেচনা করে সেদিকে যাবো কি যাবো না ভাবছি যখন, তখনি হেলেন বলে উঠল “চল দাদা উঠে দেখি না কি আছে উপরে, আর তো কখন আসা হবে না এখানে, অতএব যতোটা পাড়ি দেখে নেই’-সাথে সাথেই পুত্রদ্বয় হৈ হৈ করে ফুপ্পির প্রস্তাবে সায় দিয়ে তাকে অনুগমন করার জন্য এগিয়ে যেতেই, বুঝলাম ঐ সিড়ি শুধু আমাকে নয় ডাকছে সবাইকেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক