দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৩৯ পূর্বাহ্ণ

শান্তির মায়ের ললাটলিখন

ঘরের দুই পরাশক্তি অবশেষে অধমের হাতে ব্যাগ হস্তান্তর করার পর , দুজনকেই বললাম নিশ্চিত হয়ে নিতে যে, যার যার ব্যাগে থাকা পাসপোর্টগুলো ঠিক ঠিক বের করে নিয়েছে কি না? অবশ্য বের করে নিলেই হবে না, তার চে বড় কথা হল, সেগুলো যার যার গায়ের জ্যাকেট বা কোটের ভেতরের দিকের পকেটে নিরাপদে রাখতে হবে। বলা তো যায় না, বাইরের পকেটে রাখলে যদি বেখেয়ালে কোন পাসপোর্ট পড়েটরে যায় কোথাও! কিম্বা পকেটমারের পাল্লায় পড়ে যায় খোয়া! এ ব্যাপারে অবশ্য লাজুর সমস্যাই বেশী, কারণ সে বহন করছিল ব্যাগে, নিজ পাসপোর্ট ছাড়াও পুত্রদের পাসপোর্টও। পাসপোর্ট বিষয়ে অতিরিক্ত এই সাবধানবানী ওর কানে যেতেই, পুত্রদের পাসপোর্টগুলো আমার জিম্মায় রাখতে এগিয়ে দিতেই, নিয়মের কোন ব্যত্যয় না ঘটিয়ে বিনাবাক্যব্যয়ে মাথা ও হাত পেতে নিয়ে সেগুলো গায়ের জ্যাকেটের ভেতরের দিকের পকেটে চালান করে দিয়ে, সকলের ব্যাগ বগলদাবা করে এখানকার ওম ওম উষ্ণতার কোল ছেড়ে বাইরের হিমচ্যানেলে ঝাপ দিয়ে ব্রজেন দাশ মার্কা একটা সাতার দিয়ে পাশের দালানে যাওয়ার সঙ্কল্পে রওয়ানা করলাম।
হিমচ্যানেলে ঝপ করে নেমেই টের পেলাম যে, ঠাণ্ডা এমনিতে সবকিছু জমাট বরফ দিলেও মেজাজকে টগবগ ফুটন্তও করে তুলতে পারে কখনো। তাতেই বুজলাম কেন দীপ্র টিকিট হাতে নিয়ে গ্রেট হলে ঢোকার লাইনে দাঁড়াতে গিয়ে অকস্মাৎ বাঁধা পেয়ে, ঐরকম ক্যাম্ব্রিজ ইংলিশের তোপ ছুঁড়ছিল ঐ সিকিউরিটির দিকে। এই যেমন এখন ব্যাগ জমা রাখার ঘরের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এই হিমচ্যানেল হেঁটে পাড়ি দিতে দিতে আমারও লাগছে তীব্র রাগ এই বিল্ডিংয়ের নকশাকারের উপর। এরকম নকশার ভুল করে কিভাবে কোন স্থপতি? আরে এখানে কি মানুষ শুধু ঠা ঠা রোদ্দুরের গরমের মধ্যেই গ্রেটহল দেখতে আসবে নাকি? শীতের দিন বাদেও ঝড় বৃষ্টির সময়ও টিকিট কাটার পর যদি কাউকে আবার ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে যেতে হয় পাশের বিল্ডিংএ ব্যাগ জমা রাখার জন্য, তা হলে এটা কেমন কথা হল? এ কেমন পরিবেশ বা আবহাওয়া বিষয়ক সচেতনতা সেই এক বা একাধিক স্থপতিদের, যাঁরা করেছিলেন এ স্থাপনার নকশা সেই গত শতকের পঞ্চাশ দশকের শেষদিকে?
নাহ বেশ দ্রুতই পার হতে পেরেছি দেখছি হিম চ্যানেল! ব্যাগঘরের সিঁড়িতে পা রেখে ভেতরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে দিতে ভাবলাম, নাহ এখানকার হিম, শরীর জমিয়ে দিলেও পায়ের গতি কমাতে পারেনি মোটেও। অবশ্য ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ইঙ্গিতে নিজের অজান্তে এক্কেবারে দৌড় বা জগিং করতে করতে আসিনি যদিও ঠিক, তবে পা যে চলেছে বেশ দ্রুত বোজাই যাচ্ছে তা। ব্যাগঘরে ঢুকে কাউন্টারের ওপাশে জাপানি সুমো রেসলারদের আকারের এক বিশালদেহি মহিলা ছাড়াও আরও দু তিনজন একসময়ের আমার মতোই টিং টিংয়ে তালপাতার সেপাইয়ের চায়নিজ সংস্করণের দেখা পেলেও, কেন জানি ঐ সুমো রেসলারের সামনের কাউন্টারেই, বিনবাক্যব্যয়ে চালান করে দিলাম বগলদাবা করে আনা ব্যাগ সব।
ব্যাগ জমা দেয়ার টোকেন পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে ঘুরে হাঁটা দেবার সময় মনে হল, আরে পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে মাওয়ের চায়নার স্থপতিরা যখন এই গ্রেটহলের নকশা করেছিল, তখন তো সম্ভবত এই পৃথিবী এখনকার মতো এতো অনিরপাদ ছিল না। অবশ্য তার মানে তো এই নয় যে, এ গ্রহে তখন বিরাজ করছিল অপার শান্তি! বরং সেই সময়ে, মানে গত শতকের ষাটের, সত্তরের দশকে এমনকি আশির দশকেও পৃথিবীর দিকে দিকে পুঁজিবাদী শক্তি আর সমাজতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে অহরহ যুদ্ধ চলছিল। তথাকথিত গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী আমেরিকার চালে দিকে দিকে নির্বাচিত জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী জাতীয় নেতারা শুধু ক্ষমতাচ্যুতই হচ্ছিলেন না, হচ্ছিলেন নিহতও। জঘন্য সব সামরিক শাসকেরা আত্মপ্রকাশ করছিল দিকে দিকে। এসব নানাবিধ কারনে। যখন তখন দেশে দেশে যখন তখন বেজে উঠতো যুদ্ধের দামামা। প্রাগৈতিহাসিক মানবেরা যেমন একসময় এক গোত্র আরেক গোত্রের উপর তুমুল হিংস্রতায় ঝাপিয়ে পড়ে রক্তাক্ত করতো সবুজ বনভূমি, তেমনি গত শতকের নব্বই দশক পর্যন্ত এ গ্রহের দিকে দিকে একদেশ আরেকদেশের উপর, ট্যাঙ্ক, বিমান, মর্টার, বোমা বন্দুক নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে তুমুল আক্রোশে। সৃষ্টির সেরা জীবের অহংধারী মানুষের কারণে এ গ্রহের শান্তির মা কখনোই শান্তিতে ছিলেন না। চিরকাল অশান্তিই ছিল শান্তির মায়ের ললাটলিখন।
তবে হ্যাঁ ঐসময় সম্ভবত শুধুমাত্র এরকম স্থাপনা উড়িয়ে দেবার জন্য কোন জঙ্গিসন্ত্রাসীদল অষ্টপ্রহর সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে থাকত না, যেমন এখন থাকে দিকে দিকে আইসিস, বোকোহারাম, তালেবানরা বা তাদের অনুসারীরা। বদলে গেছে এখন অশান্তির ধরণ। যার কারণে শান্তির সংজ্ঞা গেছে বদলে, আর নাগরিক নিরাপত্তা হয়ে গেছে তুমুল অনিশ্চিত। আগে যেমন মানুষ নিজ নিরাপত্তার কারনে সহজে এড়িয়ে যেতে পারত যুদ্ধক্ষেত্র সমূহ, এখন তা পারছে না। আপাত নিরাপদ যে কোন স্থানেই আজ ঐসব জঙ্গিদের কারনে যে কোন সময় তৈরি হতে পারে যুদ্ধক্ষেত্র নয়, বরং তুমুল অনিরাপদ ও রক্তাক্ত হন্তারক অবস্থা। কারণ যুদ্ধ তো হয় যুদ্ধংদেহী দুই পক্ষের ভেতর । জঙ্গিরা তো আক্রমণ করে অকস্মাৎ নিরীহ জনগণ এমনকি শিশুদেরও। অতএব এখানে যুদ্ধ কোথায়?
এইভাবে যুদ্ধের ধরণ আর জননিরপত্তার সংজ্ঞা আমূল বদলে গিয়ে, একসময় যে মানবনিষ্ঠুরতা আজকের মতো তুমুল অনিশ্চিত ও সর্বত্রগামী হয়ে উঠবে, তা এই গ্রেটহল নির্মাতা স্থপতিরা হয়তো কল্পনাও করেননি। ছোটখাট ব্যাগে করে ভয়ংকর ক্ষমতাসম্পন্ন মারনাস্ত্র যে নেয়া যেতে পারে সেটাও হয়তোবা তখন অচিন্ত্যনিয় ব্যাপার ছিল। অতএব ওইসময় এখানে ঢুকতে কাউকে হয়তো ব্যাগ জমা করে যেতে হবে এমনটা ভাবেননি তারা। তাই হয়তো নকশা করার সময় এব্যাপারটা ধর্তব্যেই রাখেননি।
আবার মনে হল আচ্ছা, যে সময়ে গ্রেটহলের গোড়াপত্তন হয়, তখন কি এখানে চায়নিজ সাধারণ জনগণের প্রবেশাধিকার ছিল? কারণ তাদের তো ওইসময় অষ্টপ্রহর কাজে ব্যস্ত থাকার কথা কমিউনে কমিউনে। মানে ব্যস্ত ছিলেন তারা তখন আজকের মহাশক্তিধর চীনের ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণে! তাদের কি সময় ছিল এরকম একটা বিল্ডিং দেখার জন্য সময় বের করার? সময় থাকলেই বা কি, সাধ্য কি ছিল তাদের এ পর্যন্ত আসার? বা কি ছিল এখানে তাদের প্রবেশাধিকার? তবে কি এ ছিল তখন শুধুই চায়নিজ কমিউনিস্ট পাটির্র সভ্য, সদস্য আর কর্মীদের পীঠস্থান?
নাহ এসব প্রশ্ন মনে আসলেও উত্তর জানি না একটারও। তবে এটা জানি যে পশ্চিমা মিডিয়ার সাথে সুর মিলিয়ে আমাদের দেশের মিডিয়াও, রাশিয়া ও চায়নাকে লৌহ যবনিকার আড়ালের দেশ বলে যেভাবে প্রচার করতো চতুর্মুখে একসময়, তাতে অন্তত আমার এরকম মনে হতো যে ওইসময়ে সেখানে শুধু বিদেশী না, ঐসব দেশের স্বদেশীয়দেরও সর্বত্রগামী পদচারণা ছিল না। তবে আগে যেহেতু আসিনি, আসলে ঐ সময় ব্যাপারটা কী রকম ছিল তা তো জানি না; তবে এখন যে তা বদলেছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি। যার কারনেই হয়তো আজ যুগের প্রয়োজনে নিতে হয়েছে নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘোরটোপ।
এদিকে ততোক্ষণে গ্রেটহলের প্রবেশমুখে আমার উপস্থিতির ছায়া দেখতেই দীপ্র অভ্র তড়িঘড়ি দাঁড়িয়ে গেল ফের তাদের সামনের সবচেয়ে কাছের লাইনে, দেহতল্লাশির জন্য খাড়া করিয়ে রাখা সারি সারি আয়তাকার দরজার মতো স্ক্যানিং যন্ত্রের একটার ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমান করার জন্য। সাথে সাথেই তাদের অনুগামী হলো লাজু ও হেলেন। আর সবশেষে গিয়ে দাঁড়ালাম নিজে সকলের অনুগামী হতে। এরই মধ্যে আরো কিছু চায়নিজ দর্শনার্থী এ হলে এসে হাজির হলেও, ভেতরে ঢোকার লাইনে না দাঁড়িয়ে তারা দেখছি এদিক সেদিক নিজদের মধ্যে দু তিন চার পাঁচ জনের জটলা বানিয়ে চিং চাং, ফুং ফাং বলে কথা বলে যাচ্ছে তারা। দীপ্র অভ্রর সামনে যে দু তিনজন ছিলেন এই লাইনে, দ্রুতই তারা পেরিয়ে গেলেন ঐ স্ক্যানিং দরজা। ফলে আমাদেরও লাগলো না খুব একটা সময় এই নিরাপত্তা বৈতরণী পার হতে।
অতপর দুইপুত্রকে দুই হাতে ধরে লাল কার্পেটে ঢাকা সুপ্রশস্ত করিডোর ধরে হেঁটে গ্রেট হলের গর্ভে হারিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতেই, অভ্র জিজ্ঞেস করল “বাবা এটা কি? এখানে কি দেখব আমরা?”
শোন এটা হচ্ছে বেইজিঙের টপ টেন বিল্ডিং এর একনম্বর বিল্ডিং। এখানে চায়নিজ সরকারের সব বড় বড় মিটিংগুলো হয়। প্রায় দুই লাখ বর্গমিটার আয়তনের বিশাল এই হলটিতে ১০০ টার মতো নাকি মিটিং রুম আছে।
“এটা কি আমাদের যেমন বঙ্গবন্ধু চায়না ফ্রেন্ডশিপ হল আছে ঢাকায়, ওরকম কিছু নাকি?” প্রশ্ন ছুটে এলো দীপ্রর মুখ থেকে এবার
না ঠিক তা না। এটাকে বরং আমাদের সংসদ ভবনের মতো বিল্ডিং বলা যায়। আমাদের বঙ্গবন্ধু চীন মৈত্রী হলে যেমন সরকারী ছাড়া বেসরকারিও অনুষ্ঠান হয়, এমনকি হয় বিয়েশাদিও। এখানে বেসরকারি কোন অনুষ্ঠান সম্ভবত হয় না। চায়নায় তো আসলে সবই হয় সরকারীভাবে। আর জানো বাবারা বিশাল এই বিল্ডিঙটা চায়নিজ ইঞ্জিনিয়াররা নাকি মাত্র দশমাসে তৈরি করে ফেলেছিল! মায়ের পেটে মানুষের বাচ্চারা যেমন দশমাস থাকে, ব্যাপারটা অনেকটা ঐরকম। আজকের চীনের সেময়ের নেতা মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক চীনের গোড়াপত্তনের সময়টাতে, চায়নিজ ইঞ্জিনিয়ার, স্থপতি আর শ্রমিকেরা মিলে মাত্র দশ মাসে এই বিশাল হলটি তৈরি করে সারা পৃথিবীকে এক্কেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।
‘ওয়াও বাবা! ঐ যে দেখ? হোয়াট এ বিগ এন্ড বিউটিফুল আর্ট ওয়ার্ক!’ বলেই আমার হাত থেকে মুক্তি নিয়ে অভ্র দৌড়ে গেল এ রক্তলাল কার্পেটে মোড়া করিডোরের শেষ মাথার দিকে দেয়াল জুড়ে লাগানো একটা চায়নিজ পেইন্টিং এর দিকে!
প্রায় একইসাথে দীপ্রও অভ্রর পিছু পিছু ছুট লাগাতেই, হেলেনও তার হাতফোন বাগিয়ে ওদের এই ছুটন্ত ভঙ্গিমার ছবি তুলতে তুলতে অনেকটা দৌড়ের ভঙ্গিতে এগুতে লাগল। ওদের এই হঠাৎ চাঞ্চল্যের বিপরীতে নিজে এগুনো বাদ দিয়ে, স্থির দাঁড়িয়ে ঐ শিল্প কর্মটির দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলাম, ঠিক দেয়ালজুড়ে না, বরং দেয়ালের সামনের একটা বিশাল কাঠের ফ্রেমে লাগানো দেয়ালের অনেকটাই আড়াল করে রাখা ঐ শিল্পকর্মটি ঠিকঠাক মতো দেখতে হলে, দেখতে হবে তা দূরেই দাঁড়িয়েই। ভ্যাটিক্যানের সিস্টিন চ্যাপেলের ছাঁদে আঁকা মাইকেল এঞ্জেলোর অমর চিত্রকর্ম যেমন দেখতে হয় নীচে মেঝেতে দাঁড়িয়ে। তেমনি এই শিল্পকর্মটির পুরো সৌন্দর্য বুঝতে হলে দাঁড়াতে হবে দূরেই। আসলে এ পৃথিবীর অনেক সুন্দরই উপভোগ করতে হয়, দূর থেকেই। সব সুন্দরের কাছে যেতে নেই। কোন কোন সুন্দরের কাছে গেলেও, তাকে ছুতেও নেই। তাতে মোহভঙ্গ হয়। আর একবার মোহ ভেঙ্গে গেলে সে জায়গা সুড়ুত করে অনায়াসে দখল করতে পারে হতাশা এমনকি বিতৃষ্ণাও।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংকট অনেক গভীরে
পরবর্তী নিবন্ধসপরিবারে বঙ্গবন্ধু : শেখ হাসিনার স্মৃতিতে চট্টগ্রাম