টাকার নিক্তিতে জীবন
‘ওহ তোমরা চলে এসেছো? এই দীপ্র, অভ্র ঢোক তোমরা গোসল করতে। আর শোন আমার খুব ঘুম পেয়েছে , রাতের খাবারের ব্যবস্থা কর। আমি কিন্তু খুব বেশি দূরে যেতে পারব না বলে দিচ্ছি।’
প্রশ্ন, হুকুম, সিদ্ধান্ত ও অলঙ্ঘনীয় হুকুম এই চারের সমন্বয়ে জারি হওয়া উপরোক্ত বাক্য সমূহের প্রথমটি উচ্চারিত হতেই, মনের ভাবনার তাল কেটে যাওয়ায় চোখ মেলে দেখি, মাথায় টাওয়েল জড়ানো অবস্থায় স্নানঘর থেকে বেরিয়ে রুমের মধ্যে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করেছে লাজু। এদিকে মায়ের গলার স্বরে সামরিক ফরমান জারীর আবহ টের পেয়ে, দীপ্র মোবাইল ফিরিয়ে দিল তড়িঘড়ি আমার হাতে, আর অভ্রর চোখ ফিরে এল টিভির পর্দা থেকে ।
‘কি ব্যাপার শুনেছ কি তোমরা দু’জন আমার কথা’? দু পুত্রকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ফের লাজু জিজ্ঞেস করতেই
দীপ্র অনুযোগের স্বরে বলল ‘আমি তো রুমে ঢুকতেই পারছি না; হেন খুলছে না দরজা।’ ভাবটা এমন ওর যেনোবা ঐ রুমের দরজা খোলা পেলে, এতক্ষণে সে গোসল টোসল সেরে ভাল মানুষটি হয়ে বসে থাকতো। কিন্তু ও তো বুঝতে পারছে না এরকম অনুযোগ করে সে মা আর ফুফুকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মুখোমুখি, আমাদের সমাজ সংসারে যা নাকি অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ বিষয়। আর সে শাখের করাত ঝুঁকির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি অবোধ মুখ খুললাম তাড়াতাড়ি যাতে নিতান্তই নির্দোষ এই ব্যাপারটি অকারন কোন ঝড়ের কারণ না হয়ে দাঁড়ায় -বললাম শোন, আগামীকাল বেইজিং ট্যুরের জন্য নিচে কথা বলেছি, কিন্তু ফাইনাল করিনি কিছু তোমার মতামত নেবার জন্য। এখানে আমাদের দুটো অপশন আছে, এক হল টক্কা বাস, আর দুই হলো আমাদের নিজেদের জন্য আলাদা একটা ভ্যান ভাড়া করে ঘোরাফেরা করা নিজেদের ইচ্ছেমতো?
‘টক্কা বাস আবার কি ?’ অবাক জিজ্ঞাসা লাজুর -বুঝলাম টক্কা নাম বলে পড়েছি ঝক্কিতে। সাথে এও মনে পড়লো যে নিজমনে, মনে মনেই যেহেতু ঐ হফ অন হফ অফ বাসের বাংলা করেছিলাম আমি টক্কা বাস, তা তো ও জানে না। আর চট্টগ্রামেও যেহেতু থাকে নাই কখনো, অতএব এই টক্কা শব্দটির কোন মানেই জানে না ও। এ জন্যই আমাদের গ্রামে গঞ্জে প্রচলিত কথা আছে ‘এক দেশের বুলি আরেক দেশের গালি’ ফলে দ্রুতই নিজেকে সামলে বললাম -ওহ! এ হল সেই বাস, যাতে ঘুরে আমরা প্যারিস শহর দেখেছিলাম। এ বাসগুলো যে শহরে চলে, যায় ওগুলো শুধু ঘুরে ঘুরে নানান দর্শনীয় জায়গায়। দিনে টিকিট একবারই কাটতে হয় এতে, সারাদিনের জন্য। আর চলাচলও করে এরা দু তিন টা রুটে। সারাদিনের মধ্যে টিকিটধারীরা ইচ্ছেমতো যে কোন রুটের যে কোন বাসে চলতে পারে ‘আরে বুঝেছি তো। ওগুলোর কি নাম যেন ছিল, সেটা বাদ দিয়ে হঠাৎ আবার এ কি নাম দিলে। তা সেই বাসে যেতে অসুবিধা কি’?
অসুবিধা একটা আছে, প্রথম কথা হলো এখানে যে ঠাণ্ডা, প্যারিসে তো ততো ঠাণ্ডা ছিল না তাই বাস থেকে নেমে যাওয়ার পর ঘুরতেও আমাদের অসুবিধা হয় নি তেমন। আবার ঘোরাঘুরি শেষে বাসের জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করতেও সমস্যা হয়নি প্যারিসে। আর এখানে বাস থেকে নেমে কোন জায়গা দেখা শেষ হলে পরবর্তী বাসের জন্য যদি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, তবে তো ঠাণ্ডায় জমে যাবো আমরা। যতোই আমরা কাপড় পরি না কেন, সেসব যে এই শীতে তেমন কাজে লাগছে না, বুঝতেই তো পারছি তা এরই মধ্যে। দ্বিতীয়ত প্যারিসের ঐ বাসে তোমাদের নিয়ে চড়ার আগে আমার যেহেতু ঐ বাসে প্যারিস ঘোরার অভিজ্ঞতা ছিল, তাই পুরো না হলেও বেশ কিছুটা ধারণা ছিল কোন রুটের বাসে উঠলে কি দেখা যাবে।
‘শোন অতো কথার দরকার নেই। আমি কি জানি নাকি বেইজিং কোনটা নিলে ভাল হবে। এই তো এলাম প্রথম আজ। তুমি যা ভাল মনে কর সেটাই কর।’ আমাকে থামিয়ে দিয়ে এ কথা গুলো বললো ও মাথা নিচু করে, কোমর অবধি ঝুলে থাকা চুলের নীচের অংশ টাওয়েল দিয়ে মুছতে মুছতে-মনে মনে বললাম এটা তো আমার বেইজিং এ ডজনতম বারের ট্রিপ তাই আমি জানি খুব ভাল! কিন্তু মুখে তা বলার আর ঝুকি নিলাম না। বরং মিন মিন করে বললাম, আমিও তো এলাম প্রথম। তবে হিসাব করে দেখলাম ঐ হফ অন হফ অফ বাসে আমাদের পাঁচজনের টিকিট কাটতে যা লাগবে , সে টাকায় এমন কি তার চেয়ে কমে, ভ্যানই ভাড়া করা যাবে । অতএব সেটাই নেওয়া ভাল।
‘ঠিক আছে, যা ভাল মনে করো।’ বলেই ফের দু পুত্রকে বলল ও, ‘কি ব্যাপার তোমরা যে এখনো গোসলের জন্য ঢুকছ না?’ সাথে সাথে দীপ্র যাতে নিজে বাঁচার জন্য আবারো মা আর ফুফুকে মুখোমুখি না করিয়ে দেয় না বুঝেই, তা ঠেকানোর জন্য, বললাম ওকে চল যাই তোমাদের রুমে। নিশ্চয়ই হেলেন বেরিয়েছে এতক্ষণে বাথরুম থেকে আমরা উঠতেই পেছন পেছন অভ্রও উঠে দাঁড়াতেই, গম্ভীর স্বরে লাজু বলল “কি ব্যাপার তুমি আবার যাচ্ছ কোথায় ? ঢোক তুমি বাথরুমে।’
‘মা, আমরা দুজনে বাথটাবে গরম পানি দিয়ে গোসল করতে চাই, সেজন্য বাথরুমে বাথটাবে গরম পানি ছেড়ে রাখি এখন। আর ভাইয়া তুমি চলে এস এখানে।’ রুম থেকে বেরুতে বেরুতে শুনলাম পেছন থেকে আসা অভ্রর গলা।
ধারণা আমার ঠিকই ছিল। এ রুমে এসে বেল বাজাতেই হেলেন দরজা খুলে বলল, “তোরা কি এতোক্ষণ বাইরে ছিলি নাকি? এখনি ফিরলি নাকি?”
আমাদের দুজনের ফাঁক গলে ততক্ষণে সুড়ুত করে রুমে ঢুকতে গিয়ে, এতোক্ষণ রুমে ঢুকতে না পারার ঝাল ঝাড়ার জন্য ইচ্ছাকৃত একটা ধাক্কা দিল ফুপ্পিকে, দীপ্র। সে থাক্কায় একটু পিছু হটে নিজেকে সামলে নিয়ে অপ্রস্তুত হেলেন ‘কি ব্যাপার এমন করছ কেন মিউ।’ বলতেই ঠাণ্ডা গলায় দীপ্রকে বললাম ‘এটা তুমি কি করলে দীপ্র! এসো সরি বলো ফুপ্পিকে’ নিজের পিঠ ব্যাগ থেকে তড়িঘড়ি করে তার হাতযন্ত্র বের করে নিয়ে দ্রুত ফুপ্পির কাছে এসে মুখ ভার করে দীপ্র বললো ‘সরি। কিন্তু আমি তো অনেকবার বেল বাজিয়েছি তুমি তো দরজা খুলো নি। তোমার জন্যই তো আমি অ্যাপেল স্টোরটা খুঁজে বের করতে পারিনি।’ ওর অনুযোগের জবাবে বললাম ঠিক আছে, বুঝেছি তা। ফুপ্পি তো ছিল বাথরুমে তখন, তাই শুনতে পায়নি বেলে শব্দ, তা তো তোমাকে বলেছিই। আর আমি তো তোমাকে আমার ফোন দিয়েছিলাম তাঁর বদলে। তবে সে কথা থাক, এখন আইপ্যাডে খোঁচাখুঁচি করা বাদ দিয়ে, মায়ের কথা মতো গোসল করতে ঢুকে পরো বাথরুম । গোসল করার পর খুঁজো সেটা। ‘তোমার ফোন থেকে তো গুগলে ঢুকতে পারিনি। আর আমি তো এখানে গোসল করব না। তোমাদের রুমে অভ্রর সাথে গোসল করব বাথটাবে” বলল দীপ্র-ঠিক আছে তাহলে জামা কাপড় নিয়ে চলো আমাদের রুমে, বলেই ফিরতি হাঁটা দিতেই হেলেন বলল ‘একটু দাঁড়া। ওর রাতে পড়ার জামা কাপড়গুলো বের করে দিই। ওকে তুই নিয়ে যা সাথে এখন, না হয় অকারন বিরক্ত করবে ও আমাকে’। অতএব রুমের ভেতরে গিয়ে বসতেই হল। তবে না, বেশিক্ষন লাগলো না; দ্রুতই হেলেন দীপ্রর রাত্রিকালীন পোশাক ওর হাতে ধরিয়ে দিতেই , ওকে নিয়ে বেরুচ্ছি যখন পেছন থেকে বলল হেলেন ‘দাদা ক্ষিদা লাগছে।’
ঘাড় ফিরিয়ে বললাম দীপ্রকে রুমে দিয়েই আমি বেরুবো আমি ডিনার কোথায় করা যায়, তা দেখতে। বুঝলাম গোসল সারা শেষ হলে, দীপ্র না হলেও অভ্রও অবশ্যই বলবে একই কথা। অতএব দ্রুতই ডিনারের একটা বিহিত করা জরুরী হয়ে পড়েছে। নিজেদের রুমে ফিরে দেখি, গোসলের জন্য তৈরি হয়ে অভ্র বাথরুমে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে বাথটাবের পাশে, কারণ সেটা তখনো ভর্তি হতে ঢের বাকী। অন্যদিকে লাজুও বাথরুমের বিশালাকার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে করছে তার গোসল পরবর্তী প্রসাধন পরিচর্যা।
মা’কে ঠাণ্ডা রাখার টেকনিক হিসাবে, বাথটাব ভর্তি না হওয়ার পরও গোসল করার জন্যএকদম প্রস্তুত হয়ে বাথটাবের পাশে অভ্রর দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপারটা সম্ভবত দীপ্ররও মনে ধরল। অতএব রুমে ঢুকেই সেও খুলতে লেগে গেল, বেইজিং শীতের মোকাবিলার নিমিত্তে তার গায়ে বোঝাই হয়ে থাকা তিন নাকি চার স্তরের পোশাক সমূহ একে একে ।
বাথরুমের দরজার দু দিকে হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেতরে গলা বাড়িয়ে, মুখ পরিচর্যায় ব্যস্ত লাজুকে বললাম যাচ্ছি আমি বাইরে ডিনারের ব্যবস্থা করতে। কোথায় যাবে ?”
আরে বলে কি? আমি কি আমাদের ঢাকার বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছি নাকি ধানমণ্ডি ৭ নম্বরে, গুলশান ১ বা ২ নম্বরে, কিম্বা মতিঝিলে যে বলবো ওকে এখন সঠিক নাম ঠিকানা? জানি নাকি আমি এই এলাকারই নাম আছি এখন যেখানে! শুধু তো জানি, আছি রিজেন্ট বেইজিংএ। এটা যে আছে কোন ঠিকানায়, তা দেখেছি যাদিও রিজার্ভেশনের কাগজে, কিন্তু সেই চুং চাং ফুং ফাং নাম তো মনে নাই আমার। কিন্তু মনের ভেতরে ঘাই মারা এসব কথা তো বলা যাবে না মুখ ফুটে। বললাম তাই হোটেলের বাইরে যাবো। বাসে আসার সময় জানালা দিয়ে, সম্ভবত ইন্ডিয়ান হোটেল জাতীয় কিছু একটা দেখেছিলাম। খুব বেশি দূর হবে না তা, মনে হয়। যাই হেঁটে গিয়ে দেখে আসি, কতোটা দূরে আছে সেটা। খুব কাছাকাছি হলে ফিরে এসে নিয়ে যাব তোমাদের। আর যদি দূরে হয় তবে , খাবার প্যাকেট করে নিয়ে আসব সবার জন্য।
‘দেখো বেশি দেরি করো না যেন, আর আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না এখন। দূরে হউক কাছে হউক প্যাকেট করে খাবার নিয়েই এসো’ আয়নার দিকে তাকিয়ে বাথরুমের ভেতরে সারসের মতো গলা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমার চোখে চোখ রেখে বলল লাজু।
হৃষ্ট চিত্তে তথাস্তু বলে আমার সারস গলা গলা ভেতরে টেনে বাইরে যাওয়ার জন্য দরজামুখি হতেই শুনলাম বলছে ও ফের
‘আমাদের জন্য সব্জি, ডাল, মাছ যা ই নাও, দীপ্র অভ্রর জন্য কিন্তু মুরগির মাংস নেবে দুটো।’
ঠিক আছে তাই করবো বলতে বলতে নিষ্ক্রান্ত হলাম রুম থেকে। লিফটের গোড়ায় এসে নিচে যাবার বোতাম টেপার সাথে সাথেই, দেখি ডানদিকের শেষ লিফটের দরজা খুলে গেল। লিফটের ভেতরে পা রাখতে রাখতে মনে হল, এ হোটেল কর্তৃপক্ষ যেন বা জানতেন এই আমি মহামান্য জ্যাক মা’র বঙ্গ সংস্করণ, নামবো এখুনি নীচে! সে জন্যই বুঝি বা এটিকে ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে তারা এখানে, যাতে আমার মতো মাল্টি বিলিয়নারের মুল্যবান সময়ের এক মিনিটও অপেক্ষায় নষ্ট না হয়! শুনেছি জ্যাক মা, বিলে গেটস জাতীয় বিলিয়নারদের প্রতি মিনিটেরই দাম শ, নাকি হাজার, নাকি লাখ ডলার! অতএব কোথাও অনর্থক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলে নাকি তাতে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়! আচ্ছা এভাবে আর সব কিছুর মতোই রেন মেন বি, ডলার, পাউন্ড, ইউরো বা টাকার নিত্তিতে যদি কারো জীবনের মিনিট সেকেন্ড মাপা হয়, সেটা কি কোন জীবন হল?
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক